এক টিকিটে যে সত্যিই দিকশূন্যপূর যাওয়া সম্ভব, এ শুধু বাঙালিই জানে। কেননা অন্ধকার সিনেমাঘরে সে পেয়েছে একাকী উত্তমকুমারকে। বাঙালির সেই আজীবনের রূপকথাকে ফের ছুঁয়ে দেখছে এ বসন্ত। সে মরশুমেই উত্তম-যাপনে ডুব দিলেন সরোজ দরবার।
একে তো বসন্তকাল, দারুণ এ সময়! ফিরেছেন উত্তমকুমার কী জানি কী হয়!
এক টিকিটে যে সত্যিই দিকশূন্যপূর যাওয়া সম্ভব, এ শুধু বাঙালিই জানে। কেননা অন্ধকার সিনেমাঘরে সে পেয়েছে একাকী উত্তমকুমারকে। অথবা পায়নি। শুনেছে আলোর নীচে অপূর্ব সেই আলো। তার পর প্রযুক্তির প্রশ্রয়ে পেয়ে গিয়েছে গভীর নির্জনের সেই গানকে। উত্তমকুমার। বাঙালির বাড়ি থেকে পালানোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এখনও, এই ২০২৪-এও।
আরও শুনুন:
মৃত্যু, নাকি সুইসাইড! মহানায়কের প্রয়াণে কেন হাহাকার করে উঠেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়?
উত্তম-রহস্য নিয়ে বহু অক্ষর খরচ হয়েছে বহুকাল ধরেই। তবে, যা আদতে রহস্য-ই, তা অক্ষরের অতীত। ফলত, তাঁকে যত লেখার চেষ্টা করা হয়, তত তিনি লেখা ছাপিয়ে চলে যান দিগন্তে। সে এমন এক দিগন্ত যা অভিনয়ে, ব্যক্তিত্বে, রহস্যে, সংস্কৃতিতে, যৌনতার চাপা আবেদনে টলমলো, খানিক এলোমেলোও। তাকে কথায় ধরে সাধ্যি কার! সদ্য স্বাধীন একটা দেশে একই সঙ্গে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর বাসনাপূরণের প্রতিশ্রুতি হয়ে যে নীলচে চিঠি উড়ে এসেছিল সময়ের ডাকঘরে, সাদা-কালো ছবিতে তিনিই বসন্ত নামিয়ে আনার অবধারিত দেবতা। নিয়তিনির্দিষ্ট এ ভূমিকা বোধহয় জানতেন সেদিনের যুবকটিও। অভিনয়ের জন্য ঘুরেছেন ধর্মতলার আপিসে আপিসে। এমনকী ‘বসু পরিবার’-এ নায়কের ভূমিকাও পাচ্ছিলেন না। পেলেন নেহাতই বরাতজোরে, নায়ক হিসাবে যিনি নির্বাচিত তাঁর শুটিং-এর ব্যস্ততা হেতু অনুপস্থিতিতে। ততদিনে ক্লান্ত যুবক ঠিক করেই ফেলেছিলেন, এ ছবি যদি না চলে, দর্শক যদি তাঁকে না নেন, তাহলে এ লাইন ছেড়েই দেবেন। যাই হোক, ছবি তো হল। প্রজেকশন শো-এ ভেসে এল চোখা চোখা সমালোচনা। কাজটা যে মোটেই সুবিধার হয়নি, তা বুঝিয়ে দেওয়া হল মোটামুটি। বাঙালির ভাগ্যবিধাতা বোধহয় তখন অলক্ষে মুচকিই হেসেছিলেন। ‘বসু পরিবার’ মুক্তি পেল, দর্শক নিলেনও তাঁকে। আর উত্তমকুমার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখলেন,- “মুক্তি বোধহয় কেবল সেদিন ‘বসু পরিবার’ পায়নি, তার সঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল আমার অভিনয় করার বন্দিসত্তা।” তবে, এই যে প্রথমদিকে দর্শক তাঁকে নেননি, এর দরুন অভিনয়ে নিষ্ঠার দাম যে তিনি বুঝেছিলেন তাও কবুল করেছেন। অতএব উত্তমকুমার এক স্বাবলম্বন, এক নিজস্ব নির্মাণ। সময়ের চরিত্র মেনেই সময়ের থেকে এগিয়ে নিজেকে ঘষেমেজে নির্মাণ করেছেন তিনি। সময়ও নির্মাণ করেছে তাঁকে। এ এক অলৌকিক যুগলবন্দি, ইতিহাসে কদাচিৎ ঘটে। বাঙালি সুতরাং পেয়ে গেল উত্তমকুমার নামে এক আজীবনের রূপকথাকে। সৌন্দর্যপিপাসা আর যৌনতৃষ্ণার মুক্তি হয়ে তিনি পর্দায় পর্দায় ফেরি হয়ে গেলেন বাঙালির মনে মনে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে। অনায়াসে নয়, পরিশ্রম করেই পেরিয়ে গেলেন রক্তমাংসল বাস্তবতা। পরে আত্মজীবনীতে তিনি বলবেন বটে যে, ‘বিশ্বাস করুন রূপকথার রাজপুত্তুর আমি নই’, তবে বাঙালির সে-কথা বিশ্বাস করতে বয়েই গেছে!
বাঙালির উত্তমকুমার তাই ব্যাখ্যার অতীত। অতিকথা জুড়ে অসংখ্য ঘটানার সমাহার। তবু একটি ঘটনাই বোধহয় উত্তম-ইন্দ্রজাল চিনতে যথেষ্ট। বন্যাত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছেন স্বয়ং মহানায়ক। এহেন একটি ঘটনা বাঙালি জনজীবনে ঠিক কী হিল্লোল তুলতে পারে তা কল্পনা করে নেওয়া যায়। অথবা হয়তো আজ সেভাবে ভেবেও ওঠা যায় না। বরং চিনে নেওয়া যায় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়- ‘কলকাতার রাস্তায় এবং বারান্দায় কুমারী এবং বিবাহিতা সুন্দরীদের উদ্বেল, আগ্রহী সাড়া! এমন ত্রাণদান তো আর কখনও কোথাও দেখিনি। মেয়েরা সোনার গয়না ছুড়ে দিচ্ছেন উত্তমকুমারের হাতে! সত্যি দেখেছি। কিন্তু এক বিবাহিতা তরুণী নিজেকেই দিয়ে দিলেন উত্তমকুমারকে। কীভাবে? দৃশ্যটা এইরূপ। উপচে পড়ছে দোতলার বারান্দা। আমি সেই বারান্দার সামনে শ্যামবাজারের রাস্তায়। সাদা ডুরে শাড়ি আর টুকুটুকে স্লিভলেস ব্লাউজ পরা সুন্দরী সেই বারান্দার মধ্যমণি। পাশের পুরুষটি সম্ভবত তাঁর স্বামী। উত্তম জোড়হাত করে প্রার্থী ছিপছিপে সুন্দরীর কাছে। সুন্দরী মুহূর্তে এলো করলেন তাঁর ঢেউ তোলা কেশ। তারপর খুলে ফেললেন তাঁর অঙ্গের লাল ব্লাউজ। ছুড়ে দিলেন উত্তমের দিকে। ঝিলিক দিল সুন্দরীর পার্শ্ব স্তনরেখা! বন্যার শ্রেষ্ঠ ত্রাণদান!” এ ঘটনার কি কোনও ব্যাখ্যা হয়! বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে, সম্ভাবনা-অসম্ভবনায় তা রহস্যময়। তবে এ-ঘটনা এই বঙ্গে যদি কারও সঙ্গে ঘটতে পারে, তবে তিনি উত্তমকুমার-ই। তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকতেই পারে না।
আরও শুনুন:
গুন্ডাদের চোখে চোখ রেখে এগোলেন উত্তমকুমার, তারপর…
সেই উত্তমকুমার ফিরেছেন এই ২০২৪-এ। সাম্প্রতিক এক সিনেমার সূত্রে, মৃত্যুর এত বছর পরেও। সেই কলকাতা, সেই সিনেমাহল জুড়ে উত্তমের মহার্ঘ পোস্টার। আধুনিক মেট্রো জুড়ে ভাসছে তাঁর কণ্ঠ বা তাঁর কণ্ঠের অনুকরণ। সেই উত্তমের সিনেমা ঘিরে আলোচনা চলছে ইতিউতি। আঞ্চলিক সিনেমার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে এরকম একটি উত্তম-গবেষণা সিনেমাধ্যমে করা যায়, তা বিস্মিত করেছেন সমসময়ের সিনেশিল্পীদের। আর এসবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছেন সেই মানুষটি। এক শুক্রবার ‘বসু পরিবার’ না চললে যিনি এ ‘লাইন’ ছেড়েই দিতেন। বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানো কিংবা না-দাঁড়ানো নিয়ে দর্শকের মধ্যে এখন দিব্যি হাসি-মশকরা। বলিউডি পরিচালকের বাংলা সিনেমার প্রতি ছুড়ে দেওয়া ‘ঘাটিয়া’ মন্তব্য নিয়ে বিস্তর ফাটাফাটি। তবে, আঞ্চলিকতার পরিসর পেরিয়ে বাংলা সিনেমার উড়ান যে আর আন্তর্জাতিকতায় নেই, তা বোধহয় দুঃখ পেলেও মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। প্রযুক্তির দাপটে মানুষের মনোযোগের আয়ু ক্ষীণ। সিঙ্গল স্ক্রিন বিলুপ্তপ্রায়। ওটিটি-সংস্কৃতি বদলে দিচ্ছে সিনেমার মায়া। এই একেবারে নতুন, খানিক দ্বিধান্বিত, সংশয়-আকুল দিনকালে ফিরলেন তিনি। যেরকম ফেরা প্রায় সম্ভব নয়। তবে, কে না জানে উত্তমকুমার সম্ভব-অসম্ভবের অধিক। একজন সমসময়ের পরিচালক তাই যে নতুন একখানা নিরীক্ষায় তাঁকেই ফিরিয়ে আনবেন, সে তিনি শুধু উত্তমকুমার বলেই।
অন্য কেউ ভবিষ্যতে হয়তো এভাবে ফিরতেই পারেন, তবে সন্দেহাতীত ভাবে তিনিই প্রথম। বাঙালির তিনিই উত্তম, যিনি নিশ্চিন্তে চলতে পারেন এই চব্বিশেও।