দেবী গঙ্গাকে পুজো দেবেন সীতা। আর সেই পুজোয় ভোগ হবে সুরা এবং মাংসযুক্ত অন্ন। রাম বনে যাওয়ার সময় গঙ্গার কাছে এমনই মানত করেছিলেন রামের ধর্মপত্নী। যে সময়ে রাম হয়ে উঠছেন ত্যাগ বৈরাগ্যের গেরুয়া প্রতীক, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বাল্মীকি রামায়ণের এহেন বহুমাত্রিকতার খোঁজ কি আর রেখেছি আমরা?
রাম যদি চোদ্দ বছর বনবাসের শেষে নিরাপদে অযোধ্যায় ফিরে রাজ্যলাভ করেন, তবে ধুমধাম করে গঙ্গাকে পুজো দেবেন- এমনটাই মানত করেছিলেন সীতা। আর সেই পুজোয় ভোগ হবে সুরা এবং মাংসযুক্ত অন্ন দিয়ে, দেবীকে সে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন রামের ধর্মপত্নী। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেবতার ভোগ বলতে আমরা যে নিরামিষ সাত্ত্বিক আহারের কথাই বুঝি, খোদ বাল্মীকি রামায়ণ কিন্তু সে কথা বলছে না। আর দেবতাকেই যেখানে ভোগ হিসেবে মদ মাংস দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে উপাসক নিজেও যে সেই আহারের সঙ্গে পরিচিত, এমন ইঙ্গিতও থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি রামের যে সাত্ত্বিক ভাবমূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে দেশজুড়ে, তার প্রেক্ষিতে তাই বাল্মীকি রামায়ণের এই ছবি ফিরে দেখা জরুরি।
আরও পড়ুন: Ramayana: রামায়ণের আদিতে ছিলই না লক্ষ্মণরেখা! কোথা থেকে এল এই গল্প?
বাল্মীকি রামায়ণের যে সারানুবাদ রাজশেখর বসু করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, অযোধ্যা থেকে বনবাসে যাওয়ার পথে গঙ্গা পার হচ্ছেন রাম লক্ষ্মণ ও সীতা। অনুবাদক লিখছেন,
নদীর মধ্যদেশে এসে সীতা কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, গঙ্গা, মহারাজ দশরথের এই পুত্র তোমার প্রসাদে কর্তব্য পালন ক’রে চতুর্দশ বৎসর পরে আমাদের সঙ্গে নিরাপদে ফিরে যাবেন। সর্বকামপ্রদায়িনী দেবী, আমি আবার এসে প্রফুল্লমনে তোমার পূজা করব। এই নরশ্রেষ্ঠ ফিরে এসে রাজ্যলাভ করলে আমি তোমার প্রীতিকামনায় ব্রাহ্মণগণকে শত সহস্র ধেনু ও অশ্ব দান করব, তোমাকে সহস্র ঘট সুরা এবং মাংসযুক্ত অম্লের ভোগ দেব, তোমার তীরস্থ সকল দেবালয়ে ও তীর্থে পূজা দেব। (বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, সারানুবাদ- রাজশেখর বসু)
এর পরেই নদী পেরিয়ে বনে প্রবেশ করার পালা। তার আগে রাম লক্ষ্মণ চার প্রকার পশু বধ করছেন রাতের আহারের জন্য। তাদের মধ্যে রয়েছে বরাহ অর্থাৎ শুয়োর, এবং তিন ধরনের হরিণ। কবি বাল্মীকি জানাচ্ছেন, এই মাংস নিয়ে ক্ষুধিত হয়ে বনে প্রবেশ করেন তাঁরা। শুধু এখানেই নয়, একাধিকবার রামের খাদ্যাভ্যাসের পরিচয় দিয়েছেন রামায়ণের কবি। রাজা দশরথের বিলাপে জানা যায়, অযোধ্যায় থাকাকালীন রামের কাছে রান্নার তারিফ শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে সুস্বাদু পান-ভোজন প্রস্তুত করতেন রাঁধুনিরা। রামের বনবাসের পর ভরত আক্ষেপ করে বলছেন, রাম থাকাকালীন অযোধ্যার রাস্তা বারুণী মদ আর ফুল-মালা-চন্দনের গন্ধে ম-ম করত, যা এখন আর নেই। বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড জানাচ্ছে, যখন সীতার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ হয়েছে, তার আগে স্বয়ং রামচন্দ্র সীতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন মৈরেয় নামের মদ্য- “সীতামাদায় হস্তেন মধু মৈরেয়কং শুচি।”
আরও পড়ুন: ধরনা দিলেই আদায় হবে দাবি, রামায়ণ থেকেই কি জন্ম আন্দোলনের এই রীতির?
ইদানীং কালে দেশজুড়ে যে রামের ধারণা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, সেই রাম একান্তই সাত্ত্বিক। মাছ-মাংস-আমিষ ভোজনের থেকে তিনি শতহস্ত দূরে। তাই অন্যদের আমিষ ভোজন নিয়েও রামভক্তরা কখনও কটাক্ষ করেন, কখনও আবার প্রায় ফতোয়াই জারি করে বসেন। উপাসকের বিধি মেনে তাঁরা নিজেরা তো সংযমের পথে চলতে চানই, উপরন্তু সকলের জন্যই সেই একই পথ বেঁধে দিতে চান। কারণ তাঁদের চোখে রাম বনবাসে দিন কাটানো সেই পুরুষ, যিনি ফলমূল খেয়ে, বল্কল পরে, জটাধারী এক তপস্বীর জীবন কাটাচ্ছেন প্রায়। কিন্তু মূল বাল্মীকি রামায়ণের রাম, অযোধ্যায় কিংবা বনবাসে কি ঠিক এমন জীবনই কাটিয়েছিলেন? মহাকাব্য কিন্তু ঠিক তেমন কথা বলছে না। বরং বাল্মীকি রামায়ণ খোঁজ দিচ্ছে এক বহুমাত্রিক রাম চরিত্রের, কোনও একটি গণ্ডি বেঁধে দিলে যাঁকে আয়ত্ত করা মুশকিল।