নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে হলুদ জ্যাকেট পরা তরুণীর ছবি। ইউক্রেনের পতাকার সঙ্গে রং মিলেছে বলেই শত্রুদেশকে সমর্থনের অভিযোগে তাঁকে হেনস্তা রুশ পুলিশের। কিন্তু এ কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র? নানা দেশে, নানা ভাবেই কি রঙের অর্থ এমন সংকীর্ণ হয়ে উঠছে না ক্রমশ?
সম্প্রতি এক তরুণীকে পাকড়াও করেছিল পুলিশ। অপরাধ? একটি হলুদ জ্যাকেট পরা। কিন্তু তাতেই বা কী? হলুদ রঙের পোশাক তো সকলেই পরতে পারেন। আহা, তা পরতে পারেন বইকি, কিন্তু সকলের পিছনে তো আর নীল রঙের আকাশ থাকে না। কী ভাবছেন, এ তো আরোই গুলিয়ে গেল? দাঁড়ান দাঁড়ান, বুঝিয়ে বলি। আসলে দেশটার নাম রাশিয়া। মোটামুটি বছর দুই ধরে যে দেশ লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে পড়শি দেশ ইউক্রেনের উপরে। আর সেই ইউক্রেনের জাতীয় পতাকায় আছে দুটোই রং, হলুদ আর নীল। সুতরাং নীল আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে হলুদ জ্যাকেটের ছবি দিতেই রজ্জুতে সর্পভ্রম রুশ পুলিশের। তাদের সন্দেহ, নির্ঘাত ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানানোরই নয়া চাল এহেন ছবি। অতএব এই ছবিতে পুতিন সরকার ও তার সেনাবাহিনীকে অপমান করা হয়েছে, এই সন্দেহের বশে রীতিমতো পুলিশি জেরার মুখে পড়েছেন বছর আটত্রিশের সাংবাদিক অ্যান্টোনিদা স্মোলিনা।
আরও শুনুন:
দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে, তবে বদল লিখনেই
এ ঘটনা চমকে দেওয়ারই মতো। রাষ্ট্রের নজরদারি নিয়ে নতুন করে অবাক হওয়ার হয়তো আর কিছু বাকি নেই। কিন্তু স্রেফ পোশাকের রঙের উপর ভিত্তি করে এত বড় অভিযোগ করে ফেলা যায়, আর সে অভিযোগও হচ্ছে খোদ দেশের পুলিশের তত্ত্বাবধানে, এ ঘটনা বেশ অভিনবই বটে। কিন্তু ভেবে দেখলে মনে হয়, এ কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র? নাকি স্থান আর পাত্র নির্বিশেষে এ ঘটনা ক্রমশ সত্যি হয়েই চলেছে? নানা দেশে, নানা ভাবেই? রং তো আদতে জীবনকে সুন্দর করে। কিন্তু কবে থেকে তা বদলে গেল এমন বেরঙিন পরিসরে? কীভাবে রঙের সহজ স্বাভাবিক মানেগুলো বদলে গিয়ে তার উপরে এভাবে মালিকানা কায়েম হয়ে বসল রাজনীতির?
এমনিতে কোনও রঙের যা অর্থ, সে কি তার নিজের পাওয়া, নাকি তা মানুষেরই চাপানো? রঙের তো এত ভেদাভেদের জ্ঞান নেই। থাকবেই বা কী করে, সে থোড়াই জানে নিজের এতরকম অর্থ আর বৈচিত্র্য! সেসব তো মানুষই দিয়েছে তাকে। আসলে তো রঙের গায়ে যেটুকু নামপরিচয় লেগে থাকে, তার সঙ্গে নিজের মতো অর্থ জুড়েই কালার প্যালেট বানায় মানুষ। যা কোথাও ছিল না, অর্থ জুড়ে জুড়ে তাকে সত্যি করে তোলে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সেইসব অর্থের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রাঙিয়ে তোলা। কিন্তু কখন যেন সেইসব অর্থ আর এতখানি সহজ রইল না। বরং সেখানে জুড়ে যেতে লাগল কোনও কোনও গূঢ় মাত্রা। যেখান থেকে এই বিভাজন আর অসহিষ্ণুতার অর্থ চেপে বসল রঙের গায়ে। আর সেখানে একটা বড় ভূমিকা যে রাজনীতির, তা অস্বীকার করা চলে না। এই ঘটনাটি যেমন বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষিতে, দেশের ভেতরে তাকালেও কি এমন ইঙ্গিত মিলবে না? ধরা যাক, গেরুয়া রঙের কথাই। ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যে এ রঙের এক সমাহিত গম্ভীর তাৎপর্য ছিল। তা ত্যাগের রং, সন্ন্যাসের রং। অথচ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে সে রং। যে রঙে আশ্রয়ের ঠিকানা লেখা ছিল, ধর্ম নিয়ে অসহিষ্ণু আচরণের নিরিখে কখনও কখনও তা-ই হয়ে উঠছে রীতিমতো ভয়-দেখানো। একইভাবে বাংলায় একসময় লাল বলতে একটি বিশেষ দলকেই বোঝানো হত। রাজনৈতিক পালাবদলের সময় সে রংকে মুছে দেওয়ার তোড়জোড়ও দেখেছে এ রাজ্য। বিভিন্ন কিছুর রং নীল-সাদায় বদলে দেওয়া হয়েছে, এমনকি রেড কার্পেট পালটে সবুজ রঙের কার্পেটও বসানো হয়েছে সে সময়। অথচ রেড কার্পেট বিষয়টির যে আলাদা তাৎপর্য ছিল, সেখানে তো লাল কোনও রাজনীতি বহন করত না। আবার বিধানসভা নির্বাচনে যখন কোনও কেন্দ্রে হার হয়েছে শাসক দলের, পার্টি অফিসের চেয়ারের রংও বদলেছে সবুজ থেকে গেরুয়ায়। অর্থাৎ, যাবতীয় ক্ষেত্রেই রং হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবল পতাকার ইঙ্গিতবাহী।
আরও শুনুন:
চৈত্র সংক্রান্তির সঙ ছিল রঙ্গে ভরা সমাজে চোখে আঙুল দাদা
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন রংবদলের এক কাহিনি। ১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতার দিনের গল্প। তখন তাঁর বয়স বছর দশেক। সেদিন জাতীয় পতাকা তৈরির কাগজের অকুলান। তাই সবুজের জায়গায় নীল রং দিয়েই পতাকা বানিয়েছিল খুদেরা, আর তাই নিয়েই দৌড়। আসলে যে স্বাধীনতা নিজের, সেখানে নিজের রং লাগানোয় কোনও সমস্যা হয়নি সেদিন। তাতে না ঐক্যের ব্যাঘাত ঘটেছিল, না স্বাধীনতার গায়ে লেগেছিল অপমান। রঙের তো আসলে এমনই মিলিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তার বদলে রাজনীতির আঁচড় সেখানে দাগ কেটে গিয়েছে ক্রমশ। যেখানে রঙের অধিকার আর মানুষের হাতে থাকেনি। কবেই যেন সেখানে মালিকানা কায়েম করে ফেলেছে রাজনীতির নিশান।