লিঙ্গপরিচয়ে নারী। কিন্তু গুপ্তচর হিসেবে কাজ করার জন্যই নিয়েছিলেন পুরুষের ছদ্মবেশ। আর সেই সূত্রেই খোদ নেতাজির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এই নারী। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
প্রাণপণে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছেন তরুণী। পিছনে হায়েনার মতো তাড়া করে আসছে ব্রিটিশ পুলিশ। লাগাতার ছুটে আসছে গুলি। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। প্রাণের ভয় তাঁর নেই। কিন্তু তিনি যে নারী। এই মাংসলোভীরা যে কোনও নারীকে হাতে পেলে ছিঁড়ে খাবে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর নেতাজি সম্পর্কে সামান্য তথ্য পাওয়ার জন্যও ওঁরা চূড়ান্ত অত্যাচার করবে, সে কথা জানেন তিনি। তাই ছুট ছুট… জোরে, আরও জোরে। কিন্তু… হঠাৎ তিরের বেগে কী যেন একটা বিঁধে গেল পায়ের মধ্যে! হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন তরুণী। দাঁত দিয়ে সজোরে ঠোঁট চেপে ধরলেন, যাতে এতটুকু আওয়াজ না বেরোয়। বুঝতে পারলেন, ব্রিটিশের সুচতুর গুলির হাত এড়ানো গেল না শেষ পর্যন্ত। ডান পা থেকে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। এই পা নিয়ে আর দৌড়নো অসম্ভব। আধো অন্ধকারের মধ্যেই সঙ্গিনীর দিকে তাকালেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন, পালিয়ে যাও। এক্ষুনি। কিন্তু অন্যজনও যে একই আদর্শে দীক্ষিত। আহত সঙ্গিনীকে ফেলে তিনি পালাবেন না কিছুতেই। বিশেষ করে তাঁকে উদ্ধার করতে এসেই তো বিপদে পড়েছেন এই তরুণী। অগত্যা কোনওমতে একটা গাছের মাথায় উঠে পড়লেন দুজনে। তিন-তিনটে দিন লুকিয়ে রইলেন সেখানে। খাবার নেই, জল নেই, পায়ের অসহ্য যন্ত্রণা। কোনও কিছুর তোয়াক্কা নেই কারও। অবশেষে নেতাজির কাছে ঠিক পৌঁছেও গিয়েছিলেন তাঁরা।
আরও শুনুন: বাঁচাতে হবে নেতাজিকে, স্বামীকেই খুন করেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রথম গুপ্তচর নীরা
হ্যাঁ, এমনটাই ছিলেন রাজামণি। অর্থাৎ ওই আহত তরুণী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যে কজন নারী গুপ্তচর কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন তিনিই। তাঁর বাড়ি অবশ্য গান্ধীপন্থী। ধনী ব্যবসায়ী পরিবারটি মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতির অনুগামী ছিল। কিন্তু রাজামণি হাঁটলেন উলটো পথে। রেঙ্গুনে তাঁদের বাড়িতে যেদিন গান্ধীজি এসেছেন, সেদিনও দেখা গেল বাড়ির পিছনদিকে শুটিং প্র্যাক্টিস করছে ১০ বছরের কিশোরী। আর এর বছর ছয়েক পর, আইএনএ-র জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে রেঙ্গুনে এলেন নেতাজি। তাঁর যত গয়না ছিল, সবটাই আজাদ হিন্দ ফৌজের হাতে তুলে দিলেন রাজামণি। অবাক হয়ে সেই গয়না ফেরত দিতে এলেন নেতাজি। রাজামণির শর্ত ছিল, নেতাজি যদি তাঁকে আইএনএ-র শরিক করেন, তবেই তিনি গয়না ফেরত নেবেন।
আরও শুনুন: নাচের ছন্দে খসে পড়ত পোশাক, গুপ্তচর মাতা হারির শরীরী আগুনে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিত শত্রুরা
সেই থেকে শুরু। প্রথমে আইএনএ-তে রাজামণির কাজ ছিল নার্সের। সেখানেই একদিন তাঁর চোখে পড়ে গেল এক সেনার বিশ্বাসঘাতকতা। নেতাজিকে সব কথা জানালেন তিনি। আর সেই ঘটনার পরেই নেতাজি সিদ্ধান্ত নিলেন, গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করা হবে রাজামণিকে, তিনি যাঁর নাম দিয়েছেন সরস্বতী। রেঙ্গুন থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে ব্রিটিশ ছাউনিতে বালকের ছদ্মবেশে প্রবেশ করলেন সরস্বতী ও দুর্গা, আইএনএ-র দুই গুপ্তচর। লুকিয়ে গোপন কথা শোনা, ফাইল চুরি, হাতিয়ার চুরি করে নিজেদের বাহিনীকে সাহায্য করতে লাগলেন তাঁরা। ব্রিটিশ সেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে খবর পাঠাতে লাগলেন আইএনএ-কে। আর এইভাবেই তাঁরা ভেস্তে দিলেন নেতাজিকে খুনের ছক। নেতাজি যখন বার্মা সীমান্ত বরাবর আইএনএ-র ছাউনিতে যাবেন, সেই সময়ে তাঁর উপর হামলা হবে, আড়ি পেতে শুনেছিলেন রাজামণি। আর সেই খবর পেয়েই সতর্ক হয়ে যান নেতাজি।
আরও শুনুন: অস্ত্র যখন যৌনতা! শরীরের ‘টোপ’ দিয়েই অসংখ্য নাৎসি সৈন্যকে ঘায়েল করেছিল এই কিশোরী
কিন্তু আচমকাই ধরা পড়ে গেলেন দুর্গা। তাঁকে উদ্ধার করতেই নর্তকীর ছদ্মবেশে সেই কারাগারে ঢুকে পড়লেন রাজামণি। পানীয়ে আফিম মিশিয়ে নেশা করালেন প্রহরীদের। অবশেষে তিনি উদ্ধার করলেন তাঁর সঙ্গিনীকে। কিন্তু দুজনে পালাতে গিয়েই পায়ে গুলি খেলেন রাজামণি। সেই জখম অবস্থাতেই শেষ পর্যন্ত আইএনএ-র ছাউনিতে পৌঁছন তিনি। তাঁর বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করলেন নেতাজি। ডান পা-টা অবশ্য পঙ্গু হয়ে গেল বরাবরের মতোই। কিন্তু নেতাজিকে বাঁচাতে পেরেছেন, রাজামণির কাছে এই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাঁর বীরত্বের চূড়ান্ত পুরস্কার।