পায়রা নাকি শান্তির দূত। কিন্তু অশান্তি বাধাতেও যে তারা রীতিমতো পটু, সে খবর কি রাখেন? জানেন কি দুটি বিশ্বযুদ্ধে কীভাবে চর হিসেবে কাজ করেছে এই নিরীহ দেখতে পাখিগুলিই? কীভাবে বাঘা বাঘা ইন্টেলিজেন্সও ধোঁকা খেয়েছে এই প্রাণীদের কাছে?
ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ যখন থেকে শুরু হল, তখন থেকেই মানুষ বুঝেছিল গুপ্তচরের প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতখানি। কিন্তু মানুষকে চর হিসেবে কাজে লাগালে যেমন সুবিধা হয়, তেমন সমস্যাও কম নয়। একে তো বিপদের ঝুঁকি। ধরা পড়ে গেলে নিজেদের খবর শত্রুপক্ষের কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, পাশাপাশি প্রাণহানির আশঙ্কাও। আর মানুষের পক্ষে সব জায়গায় পৌঁছানোও সম্ভব নয়। বোধহয় এমন সাতপাঁচ ভেবেই মানবেতর প্রাণীদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। আর দুর্গম জায়গায় পৌঁছাতে পাখির চেয়ে ভাল বিকল্প আর কী হতে পারে! এ ব্যাপারে সবচেয়ে পরিচিত আর জনপ্রিয় হল পায়রা। পথ চেনার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য খবর আদানপ্রদানের কাজে পায়রাকে ব্যবহার করা হয়ে এসেছে বহুকাল আগে থেকেই। আর এবার তার দক্ষতাকে কাজে লাগানো হল যুদ্ধক্ষেত্রেও।
আরও শুনুন: ফেলুদার প্রতি ‘দুর্বলতা’ নেই, জানিয়ে কিশোরী ভক্তের ‘তিরস্কার’ জুটেছিল সৌমিত্রর
জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় যুদ্ধবাজই পায়রাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। মাইক্রোফিল্ম আবিষ্কারের পর পায়রার মাধ্যমে তথ্য দেওয়া-নেওয়া করা আরও সহজ হয়ে যায়। তারপর এল মাইক্রোক্যামেরা, তাও আবার স্বয়ংক্রিয়। এই ক্যামেরা টাইমারের সাহায্যে কিছুক্ষণ পর পর ছবি তুলত। এবার আর পায়রাদের রোখে কে! তাদের শরীরে এই ক্যামেরা স্ট্র্যাপ দিয়ে জুড়ে দিলেই কেল্লাফতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই পায়রা-ক্যামেরা ব্যবহার করেছিল জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা অনেক দেশই। পায়রা অনেক নিচ দিয়ে ওড়ে। ফলে তাদের শরীরে যুক্ত ক্যামেরায় অনেক বিশদে সমস্ত ছবি পাওয়া সম্ভব হয়। আর তথ্য আদানপ্রদানের কাজ তো ছিলই। বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছর, অর্থাৎ ১৯১৮ সালে আমেরিকান ৭৭ ইনফ্যানট্রি ডিভিশনের প্রায় ২০০ জন সৈনিককে উদ্ধার করেছিল ‘শে আমি’ নামের একটি পায়রা। তাঁরা এমন জায়গায় আটকে পড়েছিলেন, যেখান থেকে বেরোনোর রাস্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। অকেজো হয়ে পড়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থাও। এই পরিস্থিতিতে দুটি পায়রাকে চিঠি-সহ উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা, কিন্তু শত্রুপক্ষের গুলিতে তাদেরও মৃত্যু হয়। শেষ ভরসা ছিল এই ‘শে আমি’। পায়ে আর বুকে গুলি খেয়েও রক্তে ভেজা শরীরে সে গিয়ে পৌঁছয় বাকি দলের কাছে। তার চিঠি পেয়ে উদ্ধারকারী দলের সাহায্য আসে, বেঁচে যান সেই বন্দি সৈনিকেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এমনই বীরত্বের নজির গড়েছিল আর-এক মার্কিন পায়রা জি আই জো। মাত্র ২০ মিনিটে ২০ মাইল উড়ে গিয়ে মিত্রশক্তির প্রধান দপ্তরে জরুরি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল সে, যার ফলে শতাধিক মানুষ বিমান হানা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। এই মহাযুদ্ধ চলার সময় জার্মানির দখল করা অঞ্চলগুলিতে প্যারাসুটে করে কৌটোবন্দি পায়রাদের নামিয়ে দিত ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স। বিরোধী পক্ষের খবরাখবর জানার জন্য একটি প্রশ্নপত্রও থাকত সেই কৌটোয়। জানা যায়, প্রায় ১০০০টি পায়রা ব্রিটেনে ফিরে এসেছিল পায়ে উত্তরপত্র বেঁধে নিয়ে। জার্মানির সেনা ঘাঁটি, রাডার স্টেশনের অবস্থান, এমনকি V-1 রকেট লঞ্চের খবরও নাকি এই পায়রাদের মারফত জানতে পেরেছিল ব্রিটিশরা।
আরও শুনুন: ধোঁয়ায় ঢেকেছিল শহর, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে দেশে প্রথম আইন চালু হয়েছিল কলকাতাতেই
তাহলে বুঝলেন তো, যতই শান্তির দূত বলে পায়রাদের মাথায় তুলুন না কেন, তাদের হাঁড়ির খবর দিতে যাবেন না কিন্তু! আপনার দশাও যে তারা হিটলারের মতো করে ছাড়বে না, তার কিন্তু ভরসা নেই!