রূপকথার রাজকন্যাদের হাসিতে নাকি মুক্তো ঝরত। এখনও বিজ্ঞাপন আলো করে থাকেন যেসব সুন্দরীরা, তাঁদের রূপের পিছনে শুভ্র দন্তপংক্তির অবদান কম নয়। এমনকি মহাকবি কালিদাসও তো সুন্দরী নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে লিখে গিয়েছেন, “তন্বী শ্যামা শিখরদশনা”। তবে ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি দেখে আপনি যতই মুগ্ধ হয়ে পড়ুন না কেন, এককালে কিন্তু সাদা দাঁত থাকার কথা ভাবতেও পারতেন না এক শ্রেণির মানুষ। দাঁতে কালো রং লাগিয়ে রাখাই ছিল তাঁদের প্রথা। কেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বিলকুল না-পসন্দ ছিল তাঁদের। কিন্তু কালো দাঁত? আহা, তার কদরই আলাদা! প্রেমিকা বা নববধূর কুচকুচে কালো দাঁতের সঙ্গে ভ্রমরের পর্যন্ত তুলনা করে ফেলেছিলেন কবিরা, ভাবা যায়! আর সেই তারিফের দৌলতেই সাদা দাঁত কালো করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল মহিলা মহলে। রাজারাজড়া আর রাজদরবারের অভিজাত মানুষদের মধ্যে তো এই প্রথা আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ক্রমে সাধারণ মানুষেরাও খেয়ে না-খেয়ে দাঁত কালো করার জন্য টাকা জমাতে শুরু করলেন।
ভাবছেন তো, এমন আজব প্রথা আবার হয় নাকি? তবে খুলেই বলা যাক।
আরও শুনুন – দেওয়াল থেকে সিঁড়ি সবই তৈরি হয়েছে নুন দিয়ে! মাটির নিচে রয়েছে এই ‘ঈশ্বরের ঘর’
আজকের কথা তো নয়, এ প্রথা প্রচলিত ছিল শ-দেড়েক বছর আগে পর্যন্ত। তাও আবার প্রাচীন জাপানে। সেখানে নারীর রূপের অন্যতম মাপকাঠি ছিল কালো কুচকুচে দাঁত। হান বংশের শাসনকাল থেকে ইদো বংশের শাসন অবধি, পাক্কা ন’শো বছর ধরে বহাল তবিয়তে চলেছিল এই প্রথা, যার পোশাকি নাম ‘ওহাগুরো’। জাপানি ভাষায় “হা” শব্দের অর্থ দাঁত, এবং “কুরো” শব্দের অর্থ কালো। আর এই দুইয়ের পূর্বে সম্মানসূচক “ও” যোগ করে এই শব্দটি তৈরি। আসলে মুখের ভেতর ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি পাশবিক প্রবৃত্তির ইঙ্গিত দেয়, এমনটা মনে করতেন প্রাচীন জাপানের মানুষেরা। এদিকে সেই সময়ে জাপানে চকচকে কালো রঙের আবরণকে সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হত। ফলে দাঁতের রং হিসেবে কালোকেই বেছে নিলেন হোমরাচোমরা মানুষেরা। আমজনতাও এই প্রথা অনুসরণ করতে শুরু করল, কারণ কালো দাঁত মানেই ধরা নেওয়া হত যে দাঁতের মালিক অতি উচ্চবংশজাত। আসলে দাঁতকে কালো রঙে রাঙানো যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাধ্য পদ্ধতি ছিল যে।
আরও শুনুন – তেরো মাসে বছর, তাই এই দেশে এখন চলছে ২০১৩ সাল, জানেন এই দেশের কথা?
কেমন ছিল সেই পদ্ধতি? ভাত থেকে তৈরি জাপানি মদ বা সাকে, চা এবং ভিনিগারের মিশ্রণে লোহার গুঁড়ো ডুবিয়ে রাখা হত বেশ কয়েকদিন। লোহার সংস্পর্শে থেকে চা ও ভিনিগারের এই মিশ্রণ কালো রং ধারণ করলে এর সঙ্গে মেশানো হত হরিতকীর মিহি গুঁড়ো। এরপর ভিনিগার ও হরিতকীর গন্ধ ঢাকতে মেশানো হত লবঙ্গ এবং দারুচিনির নির্যাস। এই মিশ্রণটির নাম ছিল “কানেমিজু”। চকচকে কালো দাঁত পাওয়ার জন্য প্রতিদিন অন্তত একবার কানেমিজু দিয়ে দাঁত রাঙানো সেকালে বাধ্যতামূলক ছিল। বিবাহিতা মেয়েদের মধ্যে বিবাহপরবর্তী চিহ্ন হিসেবেও দাঁত রাঙিয়ে দেওয়া হত।
ভাবছেন, এইরকম রং লাগিয়ে লাগিয়ে দাঁতের বারোটা বাজত? সে গুড়ে বালি। ওই তিতকুটে মিশ্রণের গুণে দাঁতে জীবাণু সংক্রমণ ঘটত না একেবারেই। ফলে বয়স বাড়লেও দাঁত থাকত অটুট। তাই আজকের টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো সেকালেও জোর গলায় দাঁতের গর্ব করতে পারতেন জাপানিরা।