গ্যাস ওভেন, কি ইনডাকশন, কিংবা মাইক্রোওয়েভ আভেন, এসব কোনও কিছুরই দরকার নেই। স্রেফ দু-এক টুকরো পাথর পেলেই কেল্লা ফতে। তাতেই নাকি রান্না করা যেতে পারে জিভে জল আনা সব খাবারদাবার। হ্যাঁ, এমন সহজ উপায়ে রান্নারই হদিশ দেয় ভারতের ইতিহাস। আসুন, তাহলে শুনে নেওয়া যাক।
আজকের দিনে খাদ্যরসিকদের চেনা খাবার ‘পাত্থর কা গোস্ত’। নিজামদের শহর হায়দরাবাদের আনাচেকানাচে মেলে এই জনপ্রিয় খাবারটি। এমনকী এই আধুনিক সময়েও এই খাবারের জনপ্রিয়তা অটুট। মূলত স্বাদের কারণেই খাদ্যরসিকদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে মাংসের এই বিশেষ পদ। কিন্তু কেন এমন নাম তার? আসলে এর পিছনে রয়েছে এক মজার গল্প।
আরও শুনুন: দ্রৌপদীর হাতেই নাকি তৈরি, ফুচকার দৌলতে এবার বিশ্বসেরার খেতাব জয় কলকাতার
শোনা যায়, একবার নাকি বাঘ শিকারে গিয়েছিলেন হায়দরাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মাহবুব আলি খান সিদ্দিকি বায়াফান্দি। তা প্রাসাদেই থাকুন আর জঙ্গলেই যান, মেজাজটি তো একইরকম রাজকীয়। তাই সেই ঘোর বনে শিকারের মাঝখানেই হঠাৎ নবাবের হুকুম হল, এক্ষুনি কাবাব রান্না করে দিতে হবে তাঁকে। ভয়ে বাবুর্চি তো থরহরিকম্প! কোথায় কাবাব রান্নার শিক, কোথায় কী, আতঙ্কে তার হাত পা পেটের মধ্যেই ঢুকে যায় প্রায়। শেষমেশ নিজের গর্দান বাঁচাতে নতুন কায়দায় মাংস রান্না করার চেষ্টা করলেন সেই রাঁধুনি। একটা চ্যাপ্টা পাথর গরম করে তার উপরে মাংসের টুকরো রেখে সেঁকে ফেললেন। এদিকে সেই কাবাব নিজামের এতই পছন্দ হল যে হায়দরাবাদের নিজামি খাদ্যতালিকায় বরাবরের মতো জায়গা করে নিল এই ‘পাত্থর কা গোস্ত’।
যদিও খাবারদাবারের ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যায়, এমনটা কিন্তু এই প্রথম ঘটেনি। বস্তুত গোটা পৃথিবী জুড়েই এভাবে পাথরের উপর রান্না করার চল দেখা যায়। আসলে আদিম মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শেখে, তখন তারা মাংস ঝলসে খেতে শিখেছিল মাত্র। আধুনিক যন্ত্রপাতি তখন কোথায়! অবচেতনের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো পরবর্তীকালেও পাথরের উপর মাংস ঝলসে নেওয়া বা সেঁকে নেওয়ার মতো পদ্ধতি অবলম্বন করেছে বিভিন্ন জাতি উপজাতির মানুষেরা। বহুকাল ধরে আরব বেদুইনরা মাংস রান্না করত মাল্লা নামের গরম পাথরের বাটিতে। জাপানিদের ইশিয়াকি নামের এক বিশেষ রান্নার ধরন আছে, যেখানে তারা গরম পাথরের উপর রান্না করে। আবার ইয়াঘানরা দুটো সমতল পাথর আগুনে গরম করে নিয়ে একটার ওপর মাংস রেখে তার ওপরে আর একটা পাথর চাপিয়ে দেয়। পেরুতেও রয়েছে আগ্নেয়গিরির পাথর দিয়ে উনুন বানিয়ে রান্না করার চল।
আরও শুনুন: আইসক্রিমের দাম নাকি ২১ লক্ষ টাকা! শুনে নিন বিশ্বের ‘দামি’ খাবারগুলির কথা
ভারতেও সরাসরি কাঠকয়লা বা পাথরের ওপর রান্নার রেওয়াজ বহু আগে থেকেই। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়ে এই পদ্ধতিতে রান্না করত অনেকেই। রাজপুতদের মধ্যে এইভাবে মাংস রান্নার চল দেখা গিয়েছে। আবার পনেরো শতকে মালোয়ার সুলতান গিয়াত শাহ এবং সুলতান নাসির শাহের রান্নার বই ‘নিমাতনামাহ’তে হায়দরাবাদের ওই রান্নাটির রেসিপি মেলে। অবিভক্ত পাঞ্জাবের বালোচ প্রদেশে জোয়ার বাজরার আটা দিয়ে তৈরি রুটি তৈরি হত এই গরম পাথরের ওপরেই। লাদাখের টক রুটি খাম্বির প্রথমে গরম পাথরে সেঁকে নিয়ে তারপর সরাসরি দেওয়া হত কাঠের আগুনে। এমনকি সম্প্রতিও থিরুঅনন্তপুরমের কাছের জঙ্গলে এক উপজাতির সন্ধান পেয়েছেন শেফ রেগি ম্যাথিউজ, যারা নদী থেকে পাথর কুড়িয়ে আনে। আর সেই পাথর গরম করে তার উপর পাতার মধ্যে সাজিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানীয় মশলা মাখানো মাছ। অনেকটা যেন ভাপা মাছের রেসিপি, তাই না? একইভাবে পাথরের তৈরি উনুনে পাতায় মুড়ে মাংস রান্না করে আন্দামান নিকোবরের কোনও কোনও জনগোষ্ঠীও।
আসলে অবচেতনে এমনভাবেই বয়ে চলে মানুষের অভ্যাস আর সংস্কৃতি। কখনও আগ্নেয় শিলা, কখনও নদীগর্ভ থেকে কুড়িয়ে আনা পাথর, কখনও সেই পাথরের উপর চন্দনকাঠ কিংবা পাতার স্তূপ, এমনই নানাভাবে এখনও রান্নার ঐতিহ্য বজায় রয়েছে গোটা বিশ্ব জুড়েই। জানা যায়, কোঙ্কন সমাজে প্রত্যেকের নিজস্ব পাথর রয়েছে রান্নার জন্য। বাঙালি সমাজেও তো থাকত শিলনোড়া, যেখানে কাঁচা শাকসবজি দিয়েই তৈরি হত নানারকম পদ। গুজরাতের পাকা রাঁধিয়েরা মাংসের একরকম আরবি পদ রাঁধার জন্য পাথর নিয়ে আসেন পাটান অঞ্চল থেকে। আবার ক্যালকাটা কুকবুকে মীনাক্ষী দাশগুপ্ত জানিয়েছেন কলকাতার সব থেকে প্রাচীন বোহ্রা পরিবারের কথা, যাঁরা পাত্থর কা গোস্তের জন্য পাথর আনেন কেবল কারবালা থেকেই।
আসলে, এও যেন সুগন্ধি আতর কিংবা পারফিউমের মতোই। ঠিক কোন পাথরে কোন গন্ধ মিলবে, তা বেছে নেওয়া রাঁধুনিরই কৃতিত্ব। চকমকি পাথর যেমন, একটি পাথরের ঠিক জোড়াটি খুঁজে পেলে তবেই জ্বলে ওঠে আগুনের ফুলকি, ঠিক তেমনটাই, ঠিক পাথর পেলে তবেই জাদু দেখাতে পারে সেই পাথরের রান্না। পাথরের মাংসও তখন স্বাদে গন্ধে হয়ে ওঠে অতুলনীয়।