এটিএম জালিয়াতি থেকে নিজের অপারেশন- সবই নাকি ইউটিউব দেখে শেখা! প্রযুক্তির এই অপব্যবহার আসলে একটি প্রবণতাকেই চিহ্নিত করছে। কোনও কিছুতেই বোধহয় আর বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। শিক্ষক দিবসে কি তাহলে এবার ইউটিউবকেই শ্রদ্ধা জানানো হবে?
ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাজনের টিউব আর বোরোলীনের টিউব। এক সময় টিউব বলতে এই-ই ছিল সম্বল। তারপর জীবনে এল ইউটিউব। এল একেবারে বিপুল সমারোহে। পরিবারের কর্তা টেলিভিশনের কায়েমি চেয়ারের পায়া গেল নড়ে। বিনোদনের মুহূর্তরা টুক করে সুযোগ বুঝে দল বদলে ঢুকে পড়ল ইউটিউবে। ওটিটি-জমানার আগে ও পরে ইউ-টিউব দেখার ধরনধারণে খানিক বদল এসেছে বটে! তবে, কর্তৃত্ব একেবারে হস্তান্তরিত হয়নি। অতএব আছে ইউটিউব বহাল তবিয়তেই। বরং দিনে দিনে যেন হয়ে উঠেছে ‘গুরুমশাই’।
ইন্টারনেট বিপ্লব যে তথ্যের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাল, এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ইউ-টিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম সেক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেছে। একদিক থেকে মানুষের বিনোদনের অভ্যাস বদলেছে। টেলিভিশন বা রেডিও-র বিনোদন ছিল সংস্থা বা অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইন্টারনেটের দৌলতে মানুষ নিজের পছন্দের প্লে-লিস্ট বানিয়ে ফেলল। অর্থাৎ একজন যখন যা চাইছেন, তাই-ই পাবেন। এই গড় প্রবণতা যেন আর একটু পরে দেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাফল্যের রাস্তা খুলে দিল। অন্যদিকে, নানা তথ্য বা শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়েও যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করল ইউটিউব। বহু সেমিনার, আলোচনা, কোনও একটি বিষয়ের প্রাথমিক পাঠ পাওয়ার ব্যাপারটি কোনভাবেই মন্দ নয়। দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম হওয়ার দরুন এর জনপ্রিয়তাও প্রশ্নাতীত। ক্রমশ তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বহু বিষয়েরই আভাস পেতে ইউটিউবের দ্বারস্থ হওয়া ও মোটামুটি একটি ধারণা পেয়ে যাওয়ার সহজ পথটিকে অবহেলা করা যায় না।
:আরও শুনুন:
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভালগার’ কনটেন্ট! যত দোষ ভিনদেশের সংস্কৃতির! মন্ত্রী বলছেন…
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। তবে গোল বাধাল এই পাঠশালার যথেচ্ছ ব্যবহার। বলা ভালো, অপব্যবহার। সাম্প্রতিক দুটো ঘটনাকে নমুনা হিসাবে দেখা যায়। প্রথম ঘটনাটি মথুরার এক গ্রামের। পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন বছর বত্রিশের একটা যুবক। তারপর ঠিক করেন নিজেই নিজের অপারেশন করবেন। গুরুমশাই সেই ইউটিউব এবং ইন্টারনেট। ভাবা যেমন, কাজেও তেমন। নিজের পেটেই ছুরি চালিয়েছিলেন। তাতে আবার হিতে বিপরীত। শেষে ক্ষত সেলাই করতেও চেয়েছিলেন। তবে, শেষমেশ আর পেরে না উঠে বাড়ির লোকেদের জানান। পরে আগ্রার এক হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। জানা যাচ্ছে, যুবকের অবস্থা বেশ সঙ্গকটজনক। অপর ঘটনাটিও বেশ মারাত্মক। কলকাতায় এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এটিএম জালিয়াতির অভিযোগে। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, যে পদ্ধতিতে কাজটি করা হচ্ছিল, তার হদিশ ওই ব্যক্তি পেয়েছে ইউটিউবেই।
এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। নানা কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষ। আর তলিয়ে দেখতে দেখা গিয়েছে, সেই কাজ করার প্রাথমিক পাঠ মিলেছে ইউটিউব থেকেই। দোষ অবশ্য ইউটিউবের নয়। প্রযুক্তির দৌলতে যা হাতের সামনে পাওয়া যায়, তা কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, সেইটাই আসল কথা। আর সেই নিরিখেই এই ঘটনাগুলো মোটামুটি একটি প্রবণতা চিহ্নিত করছে। ডাক্তারি হোক বা দর্শন-ইতিহাস, যে কোনও বিষয়ে দখল পেতে গেলে যে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন তা যেন ক্রমশ ভুলে যাওয়াই রীতি হয়ে উঠেছে। হাতের সামনে পাওয়া কিছু তথ্যের ভিত্তিতেই হাতে-কলমে কাজ করতে গেলে যে বিপদ ঘটে, নানা ঘটনায় তারই পুনরাবৃত্তি। প্রচল শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের যে ভূমিকা তা যেন অস্বীকৃতই হচ্ছে এই ধরনের কাজে। অর্থাৎ এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, শিক্ষক বা এক্সপার্টের আর দরকার কী! যখন, সবকিছু ইউটিউব খুললেই জানা যাচ্ছে। গোলমাল ঠিক এখানেই। সমাজের সব জায়গাতেই এই প্রবণতার আনাগোনা। রাজনীতি বা ইতিহাসচর্চাতেও এর অন্যথা নেই। বিশেষজ্ঞদের খাটো করে দিয়েই চলছে স্বকল্পিত ইতিহাস রচনা। তাতে বিকৃতি এসে মিশছে। কিন্তু যেহেতু বিশেষজ্ঞদের ধারণাতেই প্রশ্নচিহ্ন জাগিয়ে তোলা হয়েছে, তাই তথ্য আর ভুল তথ্যের এক অবারিত জঙ্গল ঘিরে ফেলেছে চারদিকে। এই প্রবণতারই একরকম চিহ্ন যেন ইউটিউবকে গুরুমশাই ঠাওরে ফেলার মধ্যেও।
:আরও শুনুন:
মান ভাঙানোর উপায় মানি! প্রেমিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করতেই প্রতি মিনিটে টাকা পাঠাচ্ছেন যুবক
বিচ্ছিন্ন হিসাবে এই সব ঘটনা দূরে সরিয়ে রাখলে আসলে সমস্যাকেই স্বীকার করা হয় না। ইউটিউব জ্ঞানের পাঠশালা নিয়ে থাকতেই পারে। তবে যে কোনও কাজে ও শিক্ষায় বিশেষজ্ঞের গুরুত্ব স্বীকার করতেই হবে। অন্যথায় শিক্ষক দিবসে ইউটিউবকেই শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।