একসময় রাতের কলকাতার মূল আকর্ষণ ছিলেন মিস শেফালি। ক্যাবারে কুইন। তাঁর খোলামেলা শরীরের হাতছানিতে পথ ভুল হয়ে যেত তাবড় তাবড় লোকের। আলোর ফোয়ারা, মাতাল করা সুর, মদের নেশা আর পুরুষের কামনার মাঝখানে কেমন ছিল ক্যাবারে রানির জীবন? সে গল্প শুনবেন নাকি?
এই নারীর শরীরী বিভঙ্গের সামনে রোজ রাতে দুনিয়া ভুলে যায় কত ধনী বিলাসী আমিরেরা। তবুও নাচের নেশা কাটে না। ফাঁক পেলেই ছুট কোনও না কোনও সাহেবি ক্লাবে। সেখানে জোড়ায় জোড়ায় নাচ, হুল্লোড়, পানভোজন… নিজেকে পুরোপুরি ভাসিয়ে দেওয়ার সুযোগ চেটেপুটে নিতে থাকেন শেফালি। সেদিনটাও তেমনই ছিল। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তুমুল হুল্লোড়ে দেরি হয়ে গিয়েছে। শো-এর সময় হয়ে এসেছে প্রায়। কোনও মতে ফিরেই নিমেষে পোশাক বদল। স্ল্যাক্সটা খুলে, ঘাসের ঘাগরা আর বিকিনি পরে সোজা ফারপো’জ-এর ফ্লোরে। হাওয়াইয়ান নাচের ফ্লোরে প্রথমেই সুইং করতেন মিস শেফালি। সেদিন সুইং করতেই বুঝলেন, নিচ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। ব্যাপার কী? তাড়াহুড়োয় স্ল্যাক্স খোলার সময় নিচের অন্তর্বাসও খুলে ফেলেছেন, কিন্তু হাওয়াইয়ান নাচের অন্তর্বাস পরেননি! সর্বনাশ! এ পোশাক এমনিতেই শরীরের যেটুকু ঢাকতে পারে, তা প্রায় না ঢাকার মতোই। সেখানে অন্তর্বাস নেই মানে চূড়ান্ত বিপদ। কিন্তু ফারপো’জ-এর ডান্স ফ্লোর তো তার জন্য থেমে যেতে পারে না। আর যখন সেই ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আছেন কলকাতার ক্যাবারে কুইন, মিস শেফালি। তাই নাচ গড়াল নাচের মতোই। সেদিনের দর্শকদের দৃশ্যসুখ বেড়েছিল কি না, সে কথা তাঁরা বলেননি। তবে শেফালি বলেছেন, নিয়মমাফিক নাচ শেষ করে তবেই সাজঘরে ফিরেছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: বিষাক্ত সঙ্গমে ঘায়েল হবে শত্রু, বিষ পান করেই ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠত বিষকন্যারা
সে এক অন্য কলকাতা। সে কলকাতায় কেবল মদেই নেশা হয় না, নেশা হয় নারীতেও। তাদের শরীরে, শরীরী কায়দায়, চুলের টানে, ভুরুর ভাঁজে সম্মোহন ছড়ায়। তারা মাতাল করে, নিজেরাও মাতোয়ারা হয়। শহর তাদের চেনে বারের নর্তকী হিসেবে। তাদের নামেই ভিড় জমে সেই সময়ের পার্ক স্ট্রিটে। শহর এখানে ঘুমোয় না। সারা শরীরে আলো জ্বালিয়ে সে নিজে জ্বলতে থাকে, আর শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দেয় অন্যদেরও। আর সেই কলকাতার রাতের রানি হিসেবে লোকে তখন একডাকে চেনে মিস শেফালিকে। রাতে যে ফুল গন্ধ ছড়ায় আর দিনের আলোয় থাকতে পারে না, তেমনই জীবন ছিল ক্যাবারে কুইন মিস শেফালিরও।
নাহ, এমন জীবন পেতে চাননি তিনি। তখন শেফালি নন, আরতি। ছ-মাসের আরতি দাসকে নিয়ে দেশভাগের কয়েক বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর বাবা-মা। বাবা শয্যাশায়ী, মা লোকের বাড়িতে কাজ করে খাবার জোগাড় করেন, এই পরিস্থিতিতে চৌরঙ্গির এক ফিরিঙ্গি বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে বহাল হয়েছিল কিশোরী আরতি। সেখানে প্রায়ই পার্টি বসে, আর আড়াল থেকে মেমসাহেবদের নাচের ছন্দে পা মেলায় সে। যখন দেখা গেল এভাবেই অনেকরকমের নাচে পটু হয়ে উঠেছে সে, তখন পার্টির নিয়মিত অতিথি ভিভিয়েন হ্যানসেনকে ধরে বসল, যদি একটা ভালো কাজ পাওয়া যায়। পার্ক স্ট্রিটের মোকাম্বোতে গান গাইতেন ভিভিয়েন। তাঁর সুপারিশে সে সময়ের আরেক বিখ্যাত রেস্তরাঁ ফারপোজে কাজ মিলল। বার ডান্সারের চাকরি। লালবাজারে গিয়ে নিজেকে অনাথ বলে ঘোষণা করে নর্তকী হওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করলেন আরতি।
আরও শুনুন: স্তনে-নখে মাখানো বিষ, সম্মোহনে সুন্দরী বিষকন্যাকে স্পর্শ মাত্র মৃত্যু অবধারিত পুরুষের
শুধু ছাড়পত্র পেলেই তো হল না। রাতের বারে, ঘরভরা দর্শকের চোখের সামনে নাচতে গেলে প্রশিক্ষণ লাগে। প্রথম দিনই যে পোশাকটা দেওয়া হয়েছিল পরার জন্যে, তা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন আরতি। এ পোশাকে তো শরীরের বেশিরভাগটাই খোলা থাকছে। এমন পোশাকে কি সবার সামনে আসা যায়! যদিও আস্তে আস্তে সয়ে গেল সবটাই। ক্যান ক্যান, চার্লসটন, টুইস্ট, হাওয়াইয়ান হুলা এবং বেলি ডান্স শিখতে লাগলেন উদ্বাস্তু আরতি। সঙ্গে ইংরেজি আর হিন্দি শেখা, সাজপোশাক আর আদবকায়দা জানা, সবরকম তালিম চলতে লাগল। আর সেইসঙ্গে মুছে গেল পুরোনো নামটাও। আরতি হয়ে উঠলেন শেফালি। তখন কলকাতা থেকে ক্রমে বিদায় নিচ্ছেন বিদেশি নর্তকীরা। সেখানে রাতের কলকাতার স্টার হয়ে উঠলেন সেই উদ্বাস্তু মেয়েটিই। ফারপো’জ-এর পর ওবেরয় গ্র্যান্ডেও সতেরো বছর ধরে রাজত্ব চলল তাঁরই। সেখানেই ছিল নিজস্ব স্যুইট। সার্কাস অ্যাভিনিউতে মহার্ঘ ফ্ল্যাটেরও মালকিন হয়েছিলেন তিনি। সাতের দশকের কলকাতায় হাজার বিশেক টাকা রোজগার করতেন এককালের খাবার না-জোটা সেই মেয়েটি।
একসময় সুযোগ এসেছিল অভিনয়েরও। অন্তর্বাস পরে নায়কের সিগারেট জ্বালিয়ে দিচ্ছেন মিস শেফালি, প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে এই দৃশ্য চমকে দিয়েছিল সেকালের মধ্যবিত্ত বাঙালিকে। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় এর পরেও কাজ করেছিলেন সীমাবদ্ধ ছবিতে। তরুণকুমারের উদ্যোগে মঞ্চেও দেখা গিয়েছিল মিস শেফালিকে। এমন সময়ও গিয়েছে, যখন মিস শেফালির নামে বিক্রি বাড়ত টিকিটের। যদিও শিল্পীর স্বীকৃতি আর মিলল কোথায়! নৃত্যশিল্পী নন, অভিনেত্রীও নন, কেবল ক্যাবারে কুইন হয়েই থেকে গেলেন মিস শেফালি। আজকের ভিড়ে মাখা পার্ক স্ট্রিটে সেই শেফালির স্মৃতিও বা রইল কই!