যা কিছু ভালগার বা অশ্লীল, তার চর্চা সব দেশেই চলে। আর নারীকে লোভের চোখে দেখা, তার দিকে লোভের হাত বাড়ানো, তার মতামতের তোয়াক্কা না করে তার শরীরের উপর নজরদারি- এই অশ্লীলতা তৃতীয় বিশ্বে আরও বেশি করেই ছড়িয়ে আছে। তার প্রকাশ সোশ্যাল মিডিয়াতেও আসবেই, কেননা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার তো করছে মানুষই।
যা দেখতে চান কিংবা চান না, সবই পাবেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে তার সবই দেখার যোগ্য কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। আবার এ কথাও বলা যেতে পারে, কে কী দেখবে আর দেখবে না, সে-নির্বাচন তো তারই নিজস্ব। তার কি কোনও সর্বজনমান্য মাপকাঠি বেঁধে দেওয়া সম্ভব? বেঁধে দেবেই বা কে! তবে সরকার কিন্তু সে পথেই হাঁটার কথা বলছে। হ্যাঁ, লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে কার্যত তেমনই দাবি তুলেছেন কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তাঁর বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোথাও কোনও বেড়া টানা নেই। যে কেউ সেখানে যা খুশি পোস্ট করতে পারে। অতএব, কী কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছে তার উপর নজরদারি চালানোর জন্য পর্যবেক্ষকের প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আরও বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় যা কিছু অশ্লীল বা কুরুচিকর কনটেন্ট দেখা যায়, তার সবেরই দায় আসলে ভিনদেশি সংস্কৃতির। যেখান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের উৎপত্তি, এইসব কনটেন্টের উৎসও আসলে সেই ভিনদেশের রুচি- এমনটাই মত মন্ত্রীর।
তবে, যা কিছু ভালো তার সবকিছুই বেদে আছে, আর যা কিছু খারাপ তাই বিদেশের- এমন কথা কি সত্যিই খুব যুক্তিযুক্ত? একে তো ভালো বা খারাপ বিষয়টিই আপেক্ষিক হতে পারে। হ্যাঁ, নৈতিকতা আদর্শের মাপকাঠিতে কিছু তুল্যমূল্য বিচার চলতে পারে ঠিকই, কিন্তু ‘ভিন্নরুচিহি লোকঃ’, অর্থাৎ লোকভেদে রুচিভেদের কথা তো ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রেই রয়েছে। সেখানে বিদেশের সংস্কৃতি মানেই খারাপ- এমনটা কি বলা যায়? এই বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেশবিদেশের মধ্যে কাঁটাতার তোলাও খুব একটা সুবিধাজনক নয়। সর্বোপরি, এই বক্তব্যের মধ্যে দুটো বিষয় রয়েছে। এক, দেশের আমনাগরিককে ইনফ্যান্টালাইজ করা, দুই, দেশের কোনও কিছু খারাপ হতেই পারে না, অতএব খারাপ কিছু হলেই অন্যকে দোষারোপ করতে হবে- এই মনোভাব।
প্রথম যে কথা, অর্থাৎ আমনাগরিককে ইনফ্যান্টালাইজ করা বা তাদের শিশু বলে ধরে নেওয়া- এই বিষয়টি ঠিক কেমন? পরিবারের মধ্যে যেমন এ-কথা হামেশাই চলে যে, ছোটরা ভালোমন্দ বোঝে না তাই তাদের হয়ে বড়দেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এই শিশুকরণ যে কোনও ক্ষমতাকাঠামোতেই চলে। সে পরিবার হোক কি রাষ্ট্র। সোশ্যাল মিডিয়াতে যে কোনোরকম কনটেন্ট আসে আর তা দেখে অল্পবয়সিরা ভুল বুঝতে পারে, অতএব সরকারের তরফে নজরদার নিয়োগ করতে হবে- এই পুরো বিষয়টিই কিন্তু ওই শিশুকরণের দিকে ইঙ্গিত করছে। আর এই শিশুকরণের পথ ধরেই আসে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, যে কারও ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানোর অভ্যাস। রাষ্ট্রের তরফে সে অভ্যাসটি মান্যতা পেয়ে গেলে তা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পক্ষে ভালো কথা নয়।
আর দ্বিতীয় কথাটি হল, যে কোনও ভুল বা দোষকেই অন্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা। ব্যক্তির পক্ষেও যেমন এই দোষারোপের প্রবণতা সমস্যাজনক হতে পারে, ক্ষমতার ক্ষেত্রে সেই সমস্যা আরও অনেক বেশি। কেন-না ক্ষমতার দায়িত্বও অনেক বেশি। সে যদি নিজের কাজের দায়িত্ব নিজে না নিয়ে, তার জন্য কেবল অন্যদিকে দোষারোপের আঙুল তোলে- তবে তা সেই ক্ষমতাকে ভালোর দিকে ঠেলে না। এমন তো নয় যে এ দেশে খারাপ কিছুই ঘটে না। যা কিছু ভালগার বা অশ্লীল, তার চর্চা সব দেশেই চলে। আর নারীকে লোভের চোখে দেখা, তার দিকে লোভের হাত বাড়ানো, তার মতামতের তোয়াক্কা না করে তার শরীরের উপর নজরদারি- এই অশ্লীলতা তৃতীয় বিশ্বে আরও বেশি করেই ছড়িয়ে আছে। তার প্রকাশ সোশ্যাল মিডিয়াতেও আসবেই, কেননা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার তো করছে মানুষই। কোন দেশ থেকে প্ল্যাটফর্মের উৎপত্তি, তার চেয়ে বরং কোন মানুষ তা ব্যবহার করছে- তার উপরেই সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টের ধরনধারণ নির্ভর করে। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল কনটেন্টের সব দোষ কেবল ভিনদেশি সংস্কৃতির, এ কথা বললে সত্যিকারের অশ্লীলতার অভ্যাসের শিকড়ে পৌঁছনো যাবে না কখনোই। আর আমজনতার সেই অভ্যাসকে চিনতে না পারলে, কিংবা সেই অভ্যাসের মোকাবিলা করতে না পারলে, আসলে সমস্যা দেশেরই। ভিনদেশের দিকে দোষারোপের আঙুল তুলে সেই সমস্যাকে বোধহয় মোকাবিলা করা যাবে না।