সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন এক মৎস্যজীবী। তারপর কেটে গিয়েছে ৪০০ দিনেরও বেশি। সলিলসমাধি হয়েছে তাঁর, এমনটাই ভেবেছিলেন প্রিয়জনেরা। অথচ অকূল সমুদ্রের সঙ্গে একলা লড়াই করে ৪৩৮ দিন পর বাড়ি ফিরে আসেন ওই ব্যক্তি। সহায়-সম্বলহীন হয়ে সমুদ্রের মাঝে এতগুলো দিন কাটানোর এই জীবনযুদ্ধ, স্তম্ভিত করে দেয় ইতিহাসকেও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
পেশায় মৎস্যজীবী। তাই মাছধরার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরে। আর সেখানেই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে দিশা হারান ওই ব্যক্তি। চারিদিকে অকূল সমুদ্র, তার মাঝে নৌকোয় ভাসতে থাকেন তিনি। এই সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় প্রাণ হারান নৌকোয় থাকা অন্য যাত্রীটি। বেঁচে থাকার আশা ছিল না এই ব্যক্তিরও। পরিবারের লোকেরা ধরেই নিয়েছিলেন, জলের গভীরে চিরতরেই হারিয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে জলজ্যান্ত ফিরে আসেন তিনি। ঠিক ৪৩৮ দিন পর। ‘রবিনসন ক্রুশো’-র সেই গল্পের মতোই বিস্ময়কর এই মানুষটির একলা লড়াইয়ের এই গল্প।
আরও শুনুন: একই ছাদের তলায় বাস প্রেমিক ও স্বামীর, ‘ত্রিকোণ সম্পর্কে’ও সুখে সংসার মহিলার
মধ্য আমেরিকার এক সাধারণ মৎস্যজীবী ছিলেন হোসে সালভাদোর আলভারেঙ্গা। কাজ করতেন মেক্সিকোর এক মাছ ধরার সংস্থায়। স্ত্রী এবং মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁর ছোট্ট সংসার। এমনিতে ভালো মানুষ হলেও মাঝেমধ্যেই অতিরিক্ত মদ্যপান করে ফেলতেন তিনি। একদিন এমন নেশার ঝোঁকেই তাঁর মনে হয় তিনি প্রশান্ত মহাসাগরে নৌকা নিয়ে পাড়ি দেবেন। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। সকলকে তিনি জানিয়ে দেন, সমুদ্রে গিয়ে টানা ৩০ ঘণ্টা মাছ ধরবেন তিনি। আর সেই সূত্রে যা উপার্জন হবে, তা দিয়ে জীবনে খানিক স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, এমনটাই আশা ছিল তাঁর।
পরের দিনই, মেক্সিকোর ‘কোস্টা আজুল’ বন্দর থেকে, ২৫ ফুট লম্বা ইঞ্জিনচালিত ডিঙি নৌকায় শান্ত মহাসাগরে রওনা দিলেন আলভারেঙ্গা। সঙ্গী হিসেবে নিলেন তাঁদের মাছ ধরার কোম্পানিতে সদ্য আসা বছর বাইশের এজেকুয়েল কর্ডোবা’কে। যুবক কর্ডোবা আলভারেঙ্গার সঙ্গে সমুদ্রে ভাসতে চাননি। কারণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস সুবিধের ছিল না। কিন্তু সিনিয়র সহকর্মী আলভারেঙ্গা, কিছুটা জোর করেই কর্ডোবাকে নিয়ে সাগরে ভেসেছিলেন। কিন্তু তীর থেকে মোটামুটি ১৫০ কিলোমিটার দূরে পৌঁছানোর পরেই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েন তাঁরা। ঝড়ের দাপটে প্রায় মাঝ সমুদ্রে সরে আসে তাঁদের নৌকা। যখন সেই ভয়ঙ্কর ঝড় থামলে তাঁরা বুঝতে পারেন সমুদ্রের মাঝে দুজন একেবারে অসহায় হয়ে ভাসছেন। দিক হারিয়ে ফেলেছেন। সঙ্গে কোনও খাবারদাবারও নেই। কিন্তু খাদ্য পানীয় ছাড়া কতদিন আর কাটানো যায়! এরই মাঝে একদিন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন সঙ্গী কর্ডোবা। ক্রমশ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন তিনি।
আরও শুনুন: রূপের নেশায় ঘায়েল মাফিয়া ডনও! প্রেমের ‘ফাঁদ’ পেতেই আসামিদের ধরেন এই মহিলা পুলিশকর্মী
এরপরের সময়টুকু আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় আলভারেঙ্গার জন্য। সমুদ্রের মাঝে তখন কেটে গিয়েছে প্রায় ৪৩৮ দিন। হঠাৎ একদিন সমুদ্রে কিছু নারকেল ভাসতে দেখে উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে ওঠেন তিনি। অভিজ্ঞ মৎস্যজীবী বুঝতে পারেন, ভাসতে ভাসতে তিনি কোনও দ্বীপের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। হয়েওছিল তাই। ওই অবস্থাতেই ভাসতে ভাসতে তাঁর ডিঙি এসে পৌঁছায় দক্ষিণ মার্শাল আইল্যান্ড-এর অন্তর্গত ইবন এটোলে দ্বীপে। শোনা যায় দ্বীপে পৌঁছানোর পর বালুচরেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন আলভারেঙ্গা। স্থানীয় কিছু লোক তাঁকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে আশ্রয় দেন। কয়েক সপ্তাহ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন আলভারেঙ্গা। তারপর তিনি আবার ফিরে আসেন নিজের দেশে। এভাবেই ৪৩৮ দিনে প্রায় ১১৮০০ কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে, জীবনের লড়াই জিতে ফিরছিলেন হোসে সালভাদোর আলভারেঙ্গা।