বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুবিশাল আবাসনগুলিতে গিগকর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হয় আলাদা লিফট। কখনও বা লিফট নয়, যত উঁচুতলাতেই যেতে হোক না কেন, সিঁড়িই ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। বহু সময়ে গিগকর্মীরা জানিয়েছেন, ঠিক কোন কোন সমস্যাজনক পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় তাঁদের। ঠা-ঠা রোদ হোক, বা জল জমা রাস্তা, তাঁদের যেন মানুষ বলেই মনে করেন না নিয়োগকারী সংস্থাগুলো। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে, কোনও উপভোক্তা যখন কোনও গিগকর্মীর জন্য সরব হন, তখন তা পৃথক আলোচনার দাবি রাখে বৈকি।
এ পৃথিবী ঘৃণার না ভালোবাসার? আত্মকেন্দ্রিকতার নাকি সহাবস্থানের? এ-কথা ঠিক যে, ঘৃণা-বিদ্বেষের ঘটনাগুলোই যেন বেশি করে আমাদের সামনে চলে আসে। তখন টলে যায় বিশ্বাস। তবে, শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিদ্বেষের বাণে বিশল্যকরণী হয়ে থেকে যায় ভালোবাসার কাহিনিগুলোই। সে কাহিনির জন্ম দেয় জীবনই। ঠিক যেমন এক বৃদ্ধ ‘ডেলিভারি বয়’ আর উপভোক্তার গল্প।
ডেলিভারি বয়, অর্থাৎ যাঁরা গিগ কর্মী। ভারতীয় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁদের দুর্দশার কথা কারও কাছেই অজানা নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গিগকর্মীরা নিজেরাও বহুবার এ নিয়ে কথা বলেছেন। বর্তমানে তাঁদের ছাড়া মধ্যবিত্তের জীবন প্রায় অচল। প্রাথমিকভাবে হয়তো কেবল উচ্চবিত্তরাই গিগকর্মীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, যত মানুষ বুঁদ হয়েছে ‘ইনস্ট্যান্ট’ পরিষেবায়, ততই যেন গিগকর্মীরা অপরিহার্য হয়ে উঠছেন। তা সত্ত্বেও গিগকর্মীদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো যেন আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তা নিয়ে আলোচনা যেমন জরুরি, তেমন জরুরি তাঁদের প্রতি এমপ্যাথিও। ঠিক সেই কথাটিই ধরিয়ে দিলেন জনৈক উপভোক্তা।
এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে তিনি জানিয়েছেন, দিন কয়েক আগে এক অনলাইন ডেলিভারি অ্যাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অর্ডার দিয়েছিলেন তিনি। একটু পরেই অর্ডার নিয়ে হাজির হয়ে ‘ডেলিভারি বয়’। কড়া নাড়েন দরজায়। ব্যক্তিটি দরজা খুলে রীতিমতো হতবাক হয়ে যান। কারণ তাঁর বাড়ির দরজায় পৌঁছতে কম করে তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়ি চড়তে হয়েছে ডেলিভারি বয়কে। এবং দরজায় যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর বয়স কম করে হলেও ষাট পেরিয়েছে। জিনিসের ভারে নুয়ে পড়া প্রবীণকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রীতিমতো লজ্জিত হন তিনি। তবে তিনি তো জানতেন না যে, ডেলিভারি বয় প্রবীণ! আর এই বিষয়টিই ভাবিয়েছে তাঁকে। তার পোস্টে তিনি আবেদন জানিয়েছেন, ডেলিভারি সংস্থাগুলো উচিত প্রত্যেক ডেলিভারি কর্মীর বয়স এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে, তা উল্লেখ করা। এর ফলে ক্রেতা সহজেই গিগকর্মীটির অবস্থার কথা জানতে পারবেন এবং প্রয়োজনে নিজে থেকেই সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসতে পারবেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুবিশাল আবাসনগুলিতে গিগকর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হয় আলাদা লিফট। কখনও বা লিফট নয়, যত উঁচুতলাতেই যেতে হোক না কেন, সিঁড়িই ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। কখনও সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য, কখনও বা ব্যক্তিগতভাবে আবেদনের মাধ্যমে গিগকর্মীরা জানান, ঠিক কোন কোন সমস্যাজনক পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় তাঁদের। ঠা-ঠা রোদ হোক, বা জল জমা রাস্তা, তাঁদের যেন মানুষ বলেই মনে করেন না নিয়োগকারী সংস্থাগুলো। কয়েক মাস আগে আবার দক্ষিণ ভারতের একদল গিগকর্মী সরব হয়েছিলেন, পৃথক শৌচালয় চেয়ে। শৌচালয়ের অভাবই রাতের বেলায় মহিলা গিগকর্মীদের যৌন হেনস্তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এমনটা দাবি করেছিলেন তাঁরা।
চারিদিকে এত খবরের ছড়াছড়ি, তাতে মনে হতে পারে, মানুষ বোধহয় নিজের বাইরে আর কোনওকিছু নিয়ে ভাবতে ভুলেই গিয়েছে। গিগ কর্মীদের যে অসহায়তা, তার নেপথ্যেও অনেকখানি আছে মধ্যবিত্তের বিলাস-চাহিদা। অর্থনৈতিক শ্রেণিতে সুবিধাজনক জায়গায় থাকার দরুন যে চাহিদার জন্ম, তা সামাল দিতেই বড় পুঁজির সংস্থাগুলোর হাতে প্রায় পুতুল হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। অথচ এ ব্যবস্থার বদল নেই। ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে এই ব্যক্তির পোস্ট শুধু তাঁর ভাবনা হয়ে থাকেনি, ভাবনা জাগিয়েছে অনেকের মনেই। আর সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, মানুষের মন এখনও মরুভূমি হয়ে যায়নি, বরং মানুষ এখনও বাঁচে মানুষের জন্যই।