একসময় মনে করা হত, এ বুঝি এক রূপকথার শহর। আসলে বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। অতল সমুদ্রের গভীর থেকে তাঁরা তুলে এনেছেন কয়েক হাজার বছর আগের এই হারানো শহরকে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই আশ্চর্য শহরের কথা।
গমগমে এক শহর। রকমারি পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। রাজপথের দুপাশে সুদৃশ্য সব অট্টালিকা। বিলাস ব্যসনের উপাদানেরও কমতি নেই। বন্দরনগরীটিতে বিদেশি বণিকদের আনাগোনা লেগেই থাকে যে। তাদের মনোরঞ্জনের উপাদান চাই তো! কিন্তু এমনই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা নগরীটি একদিন আচমকাই উধাও হয়ে গেল। যেন ভোজবাজির মতো। প্রাচীন মিশরের পুরাণে জানা যায় হেরাক্লিয়ন নামে সেই নগরের কথা। কিন্তু কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সেই সমৃদ্ধ শহরটি?
আরও শুনুন: বিয়ে করলেই থাকতে হবে ঘরজামাই! অদ্ভুত শর্তের জেরে বর জুটছে না গ্রামের ৩০০ তরুণীর
দেড় হাজার বছর আগে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বর্ণনায় এই নগরীর কথা প্রথম জানা যায়। তাঁর মতে হেলেনকে নিয়ে স্পার্টা থেকে পালানোর সময়ে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস প্রথমে নীল নদের মোহনায় এই হেরাক্লিয়ন বন্দরে এসেছিলেন। গ্রিক ঐতিহাসিকদের মতে, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরের উত্তর-পূর্বে গড়ে উঠেছিল হেরাক্লিয়ন, যা সেকালে মিশরের অন্যতম প্রধান বন্দর ছিল। নাগরিকদের বিশ্বাস ছিল, হেরাক্লিয়নের সুখ সমৃদ্ধির পেছনে আছে বন্যা ও শস্যফলনের দেবতা হাপির আশীর্বাদ। মূলত গ্রিস ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের জন্য ব্যবহৃত হত এই বন্দর। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর কোনও এক সময় এই শহর ভূমধ্যসাগরের গর্ভে তলিয়ে যায় বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। কারও কারও মতে, কোনও বিধ্বংসী ভূমিকম্পের জেরেও ঘটতে পারে এহেন ঘটনা। এই হারিয়ে যাওয়া শহরের কথা ক্রমে ক্রমে ভুলেই গিয়েছিল সকলে। পুরনো পুথিতে এই শহরের উল্লেখ দেখে ধরে নেওয়া হয়েছিল, হারিয়ে যাওয়া শহর এল-ডোরাডো বা আটলান্টিসের মতো হেরাক্লিয়নও হয়তো এক রূপকথা মাত্র।
আরও শুনুন: যৌনাঙ্গে ক্ষতির আশঙ্কায় মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ থিম পার্কে, আর কোথায় কোথায় রয়েছে এহেন নিষেধাজ্ঞা?
কিন্তু ১৯৯৮ সালে বিখ্যাত ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্র্যাঙ্ক গুডির নেতৃত্বে একদল গবেষক ভূমধ্যসাগরের নীচে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের একটি যুদ্ধ জাহাজের খোঁজ করছিলেন। মিশরের উপকূলবর্তী সাগরের নিচে আশ্চর্যভাবে এক প্রত্ন শহরের নিদর্শন খুঁজে পান তাঁরা। এই সূত্র ধরেই ২০০০ সাল নাগাদ ইউরোপিয়ান ইনিস্টিটিউট ফর আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজির উদ্যোগে ও মিশরীয় পুরাতত্ত্ব কাউন্সিলের সহায়তায় গঠন করা হয় একটি দল। এই দলের নেতৃত্বেও ছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্র্যাঙ্ক গুডি। টানা ১৩ বছর ধরে জলের নিচে সন্ধান চালিয়ে তাঁরা উদ্ধার করেন দুশোর বেশি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, হায়ারোগ্লিফিক শিলালিপি, ধাতব জিনিসপত্র, মুদ্রা ও ফারাওদের ব্যবহৃত স্বর্ণালংকার। সেইসব নিয়ে গবেষণা করে ঐতিহাসিকেরা নিশ্চিত হন, তলিয়ে যাওয়া এই শহরটিই পুরাণবর্ণিত সেই হারিয়ে যাওয়া বন্দর-নগরী হেরাক্লিয়ন বা থনিস, গ্রিক ঐতিহাসিকেরা যার নাম দিয়েছিলেন সমুদ্রের প্রবেশদ্বার।