বাঙালির সরস্বতী পুজো শুধু যে বাইরে মূর্তির সামনে হয় তা নয়, কিছু পুজো হয় মনে মনেও। পুজোর নেমন্তন্নের ছুতোয় দেখা হওয়া, হাতে হাতে দেওয়া আলপনা, ঠাকুরমশাইয়ের ফর্দ মিলিয়ে বাজার, হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবির ভিড়, অঞ্জলির ফাঁকে চিঠি চালাচালি, এই সব মিলিয়েই তার বাণীবন্দনা। যেসব স্মৃতির বয়স বাড়ে না, তারাই ফিরে ফিরে আসে বসন্তপঞ্চমীর সকালবেলায়।
শীতের হালকা পরশ লেগে আছে বাতাসের গায়ে। হলুদ গাঁদার বনে মৃদু হাওয়ার কানাকানি। আবছা কুয়াশার ভিতর মাঘ মাসের নরম রোদ ফুটে উঠলেই বাঙালি চিনতে পারে – এ দিন বাণীবন্দনার। ‘সরস্বতী বিদ্যেবতী তোমায় দিলাম খোলা চিঠি, একটু দয়া করো মা গো বুদ্ধি যেন হয় – এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়’ – সেই কবেই তো মায়ের কাছে খোলা চিঠি দিয়ে রেখেছে ছাত্রছাত্রীরা। মা কি পেয়েছেন সেই চিঠি! কে জানে! এবার নয় অঞ্জলির সময় সামনাসামনি দাঁড়িয়েই মনের কথা বলে ফেলা যাবেখন।
সরস্বতী পুজো মানে তো ছোটদেরই রাজত্ব। বড়রা আছেন সবকিছুতেই। তবে একটু দূর থেকে। যেন দর্শক। আর ছোটরা কাঁধে তুলে নিয়েছে দায়িত্বভার। আয়োজন তো চলছে সেই কবে থেকেই। মনে মনেও তার প্রস্তুতিও সারা।
– এই তুই কুল খাবি?
– সরস্বতী পুজোর আগেই কুল খাওয়া! না বাবা ওতে আমি নেই।
– কেন, কী হবে রে তাতে!
– কী বোকা রে! জানিস না সরস্বতীর পুজোর আগে কুল খেয়ে ফেললে পরীক্ষায় একেবারে গোল্লা!
জবুথবু শীতের দিন কী করে যে হুট করে ফুরিয়ে যায় তার ঠিক নেই। দুড়দাড় করে ক্যালেন্ডারে এগিয়ে আসতে থাকে মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথি। ক্লাসে ক্লাসে এতদিনে নোটিশ চলে গেছে। মনিটর এক হাতে সামলাচ্ছে হিসাবের খাতা, অন্য হাতে মিলিয়ে নিচ্ছে নিচ্ছে চাঁদার টাকা। তার কি ঝক্কি কম নাকি! এই সব হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে ক্লাস টিচারকে। তারপর পুরোহিত ঠাকুর বাজারের ফর্দ করে দিলে বেরিয়ে পড়তে হবে। কে যাবে বাজারে? মোটামুটি উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিদেরই এই কাজে একচ্ছত্র অধিকার। সরস্বতী পুজোই তো দেয় একটু বড় হওয়ার স্বাদ। দায়িত্ববান হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। সে কাজ মাথা পেতে নিয়েছে তারা। হইহই করে চলছে আয়োজন।
আরও শুনুন: তিনি দেবী, আবার নদীও… এককালে কৃষির দেবী হিসেবেও পূজা পেতেন সরস্বতী
এর মধ্যেই চলছে অন্য স্কুলে গিয়ে নেমন্তন্নের পালা! আর গার্লস স্কুলে! ওদের স্কুলে কে যাবে? দাদারা ভাগ হয়ে যায় দলে দলে। ছোটরা দূর থেকে দেখে। কেউ কেউ সাহস করে জিজ্ঞেস করে, আমরা যাব? দাদারা উত্তর দেয় না, শুধু চোখ পাকায়। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে, রঙিন কাগজ সব তেকোনা করে কাটা হয়ে গেছে? হয়েছে খানিকটা, কিন্তু সব কি আর হয়েছে! দাদাদের গলা ভেসে আসে, এখনও হয়নি! আগে ওটা শেষ কর। ব্যস, নেমন্তন্নে যাওয়ার সব উৎসাহ মাটি। তবে গার্লস স্কুলে দাদারা কি সবাই একসঙ্গে যাবে! ধুর তাই আবার হয় নাকি! অতজন একসঙ্গে গেলে ঢুকতেই দেবে না। একদিন দুপুরে গার্লস স্কুলের গেট খুলে যায় আর হনহনিয়ে ঢুকে পড়ে কয়েকটি তরুণ সাইকেল। সবাই শুনেছে, এই স্কুলের হেড দিদিমণি নাকি ভীষণ কড়া। বুক তাই সামান্য দুরুদুরু।
– তোমরা কোন স্কুল?
– ম্যাডাম অমুক বয়েজ। সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করতে এসেছি।
– সে কী! তোমাদের স্কুল থেকে তো এর মধ্যে নেমন্তন্ন করে গেছে!
– মানে, ম্যাডাম…
– কী বলো?
– মিসটেক মিসটেক …
দিদিমণির সামনে দাদাদের মুখ শুকিয়ে এতটুকু। আর অমনি আড়াল থেকে ভেসে আসে এক-দু টুকরো হাসির কুচি। অর্থাৎ এই যে এতক্ষণের বেইজ্জতি, সবই দেখছিল কেউ কেউ। তরুণ সাইকেল এবার ফেরার পথ ধরে। আর ঠিক তখনই,
– এই ছেলেটা নাম কী রে তোর!
– ফুসমন্তর।
– ধুর! নাম কি এমন হয় কখনও!
– কেন হবে না! আগে আমার কথা শোনো…
– আজ নয়, শুনব অন্যদিন… সরস্বতীপুজোয়
– দেখা হবে?
– হবে।
সাইকেল যেন এবার পক্ষীরাজ। উড়তে উড়তে ফিরে আসে ইশকুলে। স্কুলবাড়ির ঘরদোর এর মধ্যেই ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠেছে। হাতে হাত লাগিয়ে পরিষ্কার করেছে সক্কলে। একটা শ্রেণিকক্ষ আলাদা করে সাজানো। সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বেঞ্চি। সেই ঘরেই রাখা হবে মায়ের মূর্তি। রঙিন কাগজে সাজানো সেই ঘর। গোটা স্কুলটাই সেজে উঠেছে আমপাতা আর ফুলের মালায়। এই একটা দিনই তো স্কুলবাড়িটাও একটু সাজগোজ করতে পারে। তার দুর্গাপুজোয় নতুন জামায় সাজ নেই। সরস্বতী পুজোই স্কুলবাড়ির একমাত্র উৎসব।
আরও শুনুন: সরস্বতী পুজো করার দাবিতে আন্দোলন কলেজের ছাত্রদের, মতান্তরে জড়ালেন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র
সেই উৎসবের গন্ধে ম ম করছে গোটা স্কুল। ওদিকে মেয়েরা কাটছে প্রসাদি ফল। একটু দূরে ঠাকুর এসেছে রান্না করতে। উনুনের উপর বসানো খিচুড়ির ইয়্যাব্বড় হাঁড়ি। পাশে পাশে ফালি ফালি করে কাটা বেগুনের স্তূপ। সরস্বতী পুজো মানেই তো ছোটবড় সকলে মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়া- খিচুড়ি, আলুরদম আর বেগুনি। সঙ্গে নলেন গুড়ের মিষ্টি। এমন মিষ্টি দিন কি আর দুটো হয়!
সকাল হতে না হতেই ঠাকুরমশাই তৈরি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অঞ্জলি দেবে। পুজোর কাজ তাই তিথি মেনে শুরু হয়ে গেছে সক্কাল সক্কাল। এই শুরু হল পুষ্পাঞ্জলি – বলো –
সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে |
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।
সরস্বত্যৈ নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমো নমঃ
বেদ- বেদান্ত- বেদাংগ- বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ ||
এবার হাতজোড় করে – বলো – ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
সরস্বতী পুজো মানেই এরকম হাজার স্মৃতির কোলাজ। সময় এগিয়ে যায়। একসময় যারা ছাত্র ছিল তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে কর্মজীবনে। নিয়ম মেনেই আবার আসে সরস্বতী পুজো। নতুন দিনের ছাত্ররা তখন তুলে নেয় বাণীবন্দনার ভার। শুধু মনের গোপনে বেঁচে থাকে পুরনো ছবিগুলো। সেই নেমন্তন্ন করতে যাওয়া, সেই পুরোহিতের ফর্দ মিলিয়ে বাজার, স্কুল সাজানো, অঞ্জলি- সেইসব মুহূর্তরা যেন প্রাণ পায় প্রতি সরস্বতীপুজোয়। বাঙালির সরস্বতী পুজো শুধু যে বাইরে মূর্তির সামনে হয় তা নয়, কিছু পুজো হয় মনে মনেও। স্মৃতির অঞ্জলিতে হয় সেই বাণীবন্দনা।