আর জি করে কর্মরতা চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় উঠছে কড়া আইনের দাবি। কেন্দ্রের কাছে কড়া আইন আনার দাবিতে সরব নেতা নেত্রীরা। তবে নির্ভয়া কাণ্ডের পরেও তো আইনে বদল দেখেছিল দেশ। নারীকেন্দ্রিক অপরাধের হার কি কমেছে তাতে?
আর জি করে চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ-খুনের বিচার চেয়ে উত্তাল দেশ। ধর্ষকদের শাস্তি চেয়ে ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষেরা। ধর্ষকদের ফাঁসি বা এনকাউন্টারের দাবি উঠেছে রাজ্যের নেতা-নেত্রীদের মুখে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ধর্ষণে ফাঁসির শাস্তি চাই, বিশেষ অধিবেশন ডাকিয়ে এই মর্মে আইন পাশ করানো হবে বিধানসভায়। ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য কড়া আইন আনুক কেন্দ্র, এই দাবি তুলে দিল্লি যাওয়ার কথা বলেছেন নেতারা। তবে এই প্রেক্ষিতেই এ কথা মনে না পড়ে উপায় নেই, যে, নির্ভয়া কাণ্ডের জেরেও উঠেছিল কড়া আইনের দাবি। আইনে বদল আনাও হয়েছিল সেসময়ে। কিন্তু কেবলমাত্র আইনের বদলে সমাজের নারীকে দেখার মন বদলেছে কি? শাস্তির কঠোরতা বেড়েছে, কিন্তু নারীকেন্দ্রিক অপরাধের হার কি কমে গিয়েছে?
আরও শুনুন:
বাড়ছে ধর্ষণের হার, তুলনায় শাস্তি হচ্ছে কি! আর জি কর যে প্রশ্ন তুলল ফের
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর, চলন্ত বাসে ধর্ষণ করা হয়েছিল ২৩ বছর বয়সি তরুণীকে। নির্ভয়ার মৃত্যুর পর বদল আনা হয়েছিল ধর্ষণ-প্রতিরোধী আইনে। ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৩ বা নির্ভয়া অ্যাক্ট জানায়, মেয়েদের উপর অত্যাচার, বিশেষত ধর্ষণ, যৌন হেনস্তা, অ্যাসিড ছোড়ার মতো অপরাধে তদন্ত এবং শাস্তির ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে। তৎকালীন ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের যে সংজ্ঞা ছিল, সেই সংজ্ঞা বদলানো হয়। কেবলমাত্র পুরুষাঙ্গের অনুপ্রবেশকেই যে ধর্ষণ বলা হবে না, অন্য যে কোনও বস্তুর পেনিট্রেশনও যে ধর্ষণের আওতায় পড়বে, সে কথা মেনে নেয় আদালত। এজ অফ কনসেন্ট নির্ধারিত হয় ১৮ বছর বয়সে। ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি বাড়ানো হয়। অন্তত ৭ বছরের কারাবাসের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ বছর। ধর্ষণের জেরে নির্যাতিতার মৃত্যু হলে বা কোমায় চলে গেলে শাস্তির মেয়াদ অন্তত ২০ বছর হবে, বলা হয়। ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে তার শাস্তির জন্য নতুন ধারা যোগ করা হয়। একইভাবে কোনও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা না করলে সেখানেও শাস্তি বরাদ্দ হয়। একইসঙ্গে অ্যাসিড আক্রমণ, কোনও মেয়েকে লুকিয়ে দেখা বা ছবি তোলা, এই জাতীয় অপরাধের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থার কথা বলা হয়। ধর্ষণের দ্রুত বিচার নিয়ে ২০১৯ সালে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট প্রকল্পও চালু করেছে কেন্দ্র।
আরও শুনুন:
দেশজুড়ে আলোড়ন, আর জি কর কাণ্ড মনে করাচ্ছে যেসব ধর্ষণ মামলা
আইন বদলেছে বটে। কিন্তু সে আইন কতখানি কার্যকর হল, সেটাই আসল কথা। আইনজীবীদের একাংশও মনে করছেন, সেই কার্যকারিতার বিষয়টি প্রশ্নাতীত নয়। আর জি কর আবহে কেন্দ্র সরকার যেমন দাবি করেছে, যতগুলি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু করার কথা, বাংলায় ততগুলি কোর্ট চালু করা যায়নি এখনও। আর কেবলমাত্র আইন দিয়েই তো অপরাধ নির্মূল করা যায় না। আইন অপরাধের শাস্তি দিতে পারে, কিন্তু অপরাধমনস্কতা উপড়ে না ফেললে নতুন অপরাধ থামবে কেমন করে! নির্ভয়ার ঘটনার এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেশজুড়ে অগণিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নির্ভয়ার ঘটনা যেমন দেশজুড়ে তোলপাড় ফেলেছিল, এরপরেও একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ভয়াবহতার বিচারে আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে। আর সেইসব ঘটনার নিরিখে দেখা গিয়েছে, নির্যাতিতার পোশাক-চরিত্র-ধরনধারণ নিয়েই আগেভাগে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। আমজনতা থেকে নেতা থেকে আইনজীবীরাও। কেউ যে পোশাকই পরুন, কেউ যখন যেখানেই যান না কেন, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গায়ে হাত দেওয়াটাই যে অন্যায়- এই সহজ কথাটা আমরা এখনও সহজ করে বলে উঠতে পারছি না। রাতের ডিউটিতে কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে সেই ডিউটিতে সুরক্ষা লাগু করার আগেই কথা উঠছে মেয়েদের রাতের ডিউটি বন্ধ করে দেওয়ার। ধর্ষণের কড়া শাস্তি যেমন জরুরি, তেমনই লিঙ্গবৈষম্যের এই মানসিকতা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করা জরুরি। ধর্ষণ-প্রতিরোধী আইনের বদল সত্ত্বেও নারীনিগ্রহের প্রবণতা দেখে সে কথাই মনে হয়।