তৈরি করেছিলেন মুঘল সম্রাট। অন্দরমহলে রয়েছে সম্রাটের প্রিয় বেগম মুমতাজের সমাধি। প্রতিদিন শয়ে শয়ে ভিড় জমান সৌধের সৌন্দর্য দেখার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সৌধের বাইরে এত তুলসী গাছ কেন? হিন্দুধর্মে যে গাছকে দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয়, সেই গাছ এত সংখ্যায় কেন রয়েছে তাজমহলের বাইরে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
কেউ কেউ দাবি করেন, তাজমহল আসলে শিবমন্দির। পালটা তাজমহলে নমাজ পড়ার চেষ্টা করতে দেখা যায় কাউকে। কখনও সৌধের অন্দরমহলে গঙ্গাজল নিয়ে ঢোকার চেষ্টা, কখনও অন্য কোনও দাবি, সবমিলিয়ে তাজমহলকে সামনে রেখে ছোটখাটো সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা লেগেই থাকে। এসবের মাঝে নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সৌধের চারপাশে একাধিক তুলসী গাছ। তাতেই প্রশ্ন উঠছে, এখানে এই গাছ কেন?
হিন্দুদের কাছে তুলসী অতি পবিত্র। ওষধি হিসেবে তো বটেই, শাস্ত্রেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। স্বয়ং নারায়ণের পুজো তুলসী ছাড়া অসম্ভব। পুরাণের গল্পেও উল্লেখ মেলে তুলসীর। দেশের যে কোনও বিষ্ণু মন্দিরে গেলেই তুলসী গাছ চোখে পড়বে। পুরীর জগন্নাথ মন্দির বা বৃন্দাবনে তুলসীর ঘন বন রয়েছে। কিন্তু সেই একইরকম তুলসীর বন যদি তাজমহলে দেখা যায়? অবাক করার মতো বিষয় বটে। তবে বাস্তবে এমনটাই রয়েছে। তাজমহলের বাইরে যে সুবিশাল বাগান রয়েছে তাতে তুলসীর সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। সরকারি সংরক্ষণের আওতায় থাকা এই বাগানে কেউ ফুল ছিঁড়তে পারেন না। তুলসী পাতা তোলার ক্ষেত্রেও একই নিষেধাজ্ঞা। তাহলে এই গাছ কেন রয়েছে সেখানে?
এমনিতে তাজমহল নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। নানা কারনে শিরোনামে উঠে আসে সৌধের নাম। ইতিহাস জানায়, মুঘলদের বিরুদ্ধে রীতিমতো রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রাজস্থানের কোনও কোনও রানা। কিন্তু জয়পুর সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। বরাবরই মুঘল ঘনিষ্ঠ ছিল জয়পুরের রাজপরিবার। রাজা মানসিংহ ছিলেন সম্রাট আকবরের অন্যতম সেনাপতি। সেই সূত্রেই যমুনার তীরের ওই জমি মানসিংহের হাতে এসেছিল বলে জয়পুর রাজপরিবারের দাবি। জানা যায়, তাজমহল গড়ে তোলার জন্য রাজা মানসিংহের বড়সড় বাগানবাড়ি সহ ওই জমিটিকেই মনে ধরেছিল সম্রাটের। সেসময় জয়পুর বংশের রাজার শিরোপা পেয়েছেন মানসিংহের উত্তরাধিকারী জয়সিংহ। মুঘলদের বশংবদ রাজা জয়সিংহ সম্রাটের বাসনার কথা জানা মাত্রই জমিটি তাঁকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সম্মত হননি শাহজাহান। কারণ ইসলাম ধর্মের নির্দেশ মোতাবেক, দানে পাওয়া বা ছিনিয়ে নেওয়া জমিতে পবিত্র সমাধি নির্মাণ করা অনুচিত। সেই সূত্র ধরেই তাজমহলের সঙ্গে ওয়াকফের নাম জড়ায়। আবার এই জমিতে কোনও মন্দির ছিল কি না, তার কোনও উল্লেখ নেই কোথাও। বরং ঐতিহাসিকেরা জানিয়েছেন, ওই রাজবংশে সকল রাজাই মাতৃপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন। একমাত্র উনিশ শতকে দ্বিতীয় সওয়াই রাম সিংহকে শিবপূজা করতে দেখা গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। সুতরাং ওই জমিতে শিবমন্দির থাকার সম্ভাবনা কতটা, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গিয়েছে। কিন্তু এইসব সংশয় সত্ত্বেও আদৌ থামছে না তাজমহল বিতর্ক।
যদিও সবসময় যে বিতর্ক নয়। কখনও সুখ্যাতি, কখনও বিশেষ ঘটনা, এইসব নানা কারনে তাজমহল আলোচনায় থাকে। কিছুদিন আগেই জানা গিয়েছে, গত অর্থবর্ষে তাজমহল থেকে যোগীরাজ্যের সবথেকে বেশি আয় হয়েছে। পর্যটকের ভিড়ের নিরিখেও দেশের বহু জনপ্রিয় জায়গাকে পেছনে ফেলছে তাজমহল। তবে এবারের আলোচনার বিষয় তাজমহলের বাইরে থেকে তুলসীগাছ নিয়ে। যে গাছ বিষ্ণু মন্দিরের সামনে থাকে, সেই গাছ কীভাবে তাজমহলে এল?
বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন এক যুবক। তাঁর দাবি, তুলসীগাছের নানা গুণের কারণেই তাজমহলের বাগানে রাখা হয়েছে। কোনও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নয়, ২০০৯ সালে বনবিভাগের তরফেই এই এলাকায় প্রচুর তুলসীগাছ লাগানো হয়। তবে সেই গাছ এতদিন থাকা সম্ভব নয়। সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন। এবং সেটাই করা হয় তুলসীর গুণের কথা ভেবে। বলা হচ্ছে, একটা তুলসী গাছ অন্তত ১০০ বর্গমিটার এলাকা পরিশোধন করতে পারে। অন্যান্য গাছের তুলনায় এর থেকে অক্সিজেন নির্গমনের পরিমাণটাও অনেক বেশি। সারাদিনে প্রায় ২০ ঘণ্টা অক্সিজেন ছাড়তে পারে তুলসী। সুতরাং যে এলাকায় এই গাছ থাকবে তার বাতাস অনেকটাই পরিশোধিত হবে। আর সেই কারণে এখনও যত্ন সহকারে তাজমহলের বাইরে তুলসীর পরিচর্যা করা হয়।