চিতোরের রানার প্রতিজ্ঞা বাঁচাতে মাটি দিয়ে নকল গড় বানিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রীরা। ঠিক তেমন ভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে নকল শহর বানিয়ে রেখেছিল একটি দেশ। এতটাই অবিকল ছিল সেই নকল শহর, যে দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় ছিল না কোনটা সত্যি আর কোনটা মিছিমিছি! জানেন, কোথায় ঘটেছিল এই ঘটনা? আসুন, শুনে নিই।
এ যেন ঠিক নকল বুঁদির গড়ের গল্প। অবিকল বুঁদির কেল্লার মতোই মাটির কেল্লা গড়ে রাজার প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলেন তাঁর পারিষদবর্গ। কী-ই বা করতেন! বুঁদির গড় ধ্বংস না করে জলস্পর্শ করবেন না বলে ধনুক ভাঙা পণ নিয়েছিলেন যে রাজা। এ শহরও বানানো হয়েছিল ধ্বংসের জন্যই। তবে শত্রুকে দিকভ্রষ্ট করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আসল শহর যাতে যুদ্ধবোমার কবল থেকে বাঁচতে পারে তার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল সেই রেপ্লিকা শহর।
আরও শুনুন: শত্রুদের চোখে ধুলো দিতে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল আস্ত তাজমহল, কীভাবে জানেন?
সময়টা ১৯১৭-১৮। প্রখম বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। যখন তখন যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলতে পারে জার্মানি। মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ছবির মতো সুন্দর প্যারিস শহরটি। আতঙ্কে দিন কাটাতেন বাসিন্দারা। কীভাবে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচানো যায় নিজের শহরকে, চিন্তায় ঘুম ছুটেছিল সরকারের।
সে সময় সেনাবাহিনীর মাথায় আসে একটা অভিনব পরিকল্পনা। নকল বুঁদির গড় গড়বে তারাও। বোকা বানাবে শত্রুদেশকে। মূল ভাবনার পিছনে ছিল বায়ুসেনা। বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার উপরে দায়িত্ব পড়ে নকল শহর তৈরির। যা বিমান থেকে দেখতে লাগে অবিকল আসল প্যারিসের মতোই।
প্যারিস থেকে দূরে, উত্তর দিকে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে গড়ে উঠল নকল শহর। যাতে সেখানে বোমা পড়লেও বাসিন্দাদের গায়ে তাঁর ছোঁয়াচ এসে না লাগে। নকল শহর যাতে এক্কেবারে আসলের মতোই দেখায়, তার জন্য কম সাধ্যসাধনা করেননি প্যারিস কর্তৃপক্ষ। যাতে বিমান থেকে পরিষ্কার ভাবে শহরটি দেখা যায় তার জন্য নকল শহরের প্রত্যেকটি রাস্তা ইলেকট্রিক আলোয় ভরিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার ফারনান্দ জাকোপোজিকে। ইলেকট্রিক আলো মানেই তো সেখানে মানুষের বসতি রয়েছে। জার্মানদের সেটাই বোঝাতে চাইছিলেন প্যারিস কর্তৃপক্ষ। প্রচুর অর্থও খরচ হয়েছিল নকল শহর বানিয়ে তুলতে।
আরও শুনুন: আটত্রিশ মিনিটের যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল শ-পাঁচেক মানুষের, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট যুদ্ধের কাহিনি জানেন?
ফরাসি সেনা যেন চাইছিলই, নকল প্যারিসের উপরে বোমাবর্ষিত হোক। নকল শহরের পাশাপাশি গেরে দু নর্ড রেল স্টেশন, আর্ক দে ট্রায়ম্ফি নামে একটি মনুমেন্ট, প্য়ারিস অপেরা-সব কিছুই হুবহু তৈরি করেছিলেন নকল শহরে। গোটা কাজটাই ছিল নিখুঁত। নকল বাড়িগুলিকে স্বচ্ছ ভাবে রং করা হয়েছিল, এমনকি কারখানার ছাদগুলোকে যাতে অপরিষ্কার দেখায়, সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন ফরাসিরা। ছিল নকল রেললাইন, এমনকি নকল ট্রেনও।
সর্বকালের সেরা সামরিক পরিকল্পনাগুলির একটি ছিল এই নকল প্যারিস গড়ার ভাবনা। তবে সৌভাগ্যবশত জার্মান বাহিনীর হামলার মুখে পড়তে হয়নি নকল প্যারিসকে। তার আগেই ইতি পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যে ভাবে ঝড়ের গতিতে গড়ে তোলা হয়েছিল নকল প্যারিস, তাকে ইতিহাসের তলায় ঢেকে ফেলতেও বেশি সময় নেননি ফরাসিরা।