ইঁদুর গণেশবাহন। ইঁদুরের কথা মনে করলে সেই অনুসঙ্গই বেশি মনে পড়ে। এ দিকে গৃহস্থ তেমন পছন্দও করেন না এই প্রাণীটিকে। ঘরে ইঁদুর মানেই তো কেটেকুটে ধ্বংস করবে সব। আর রান্নাঘরের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। এই ইঁদুরের উৎপাতেই উত্যক্ত শহরবাসী ডেকে এনেছিল হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে। কিন্তু ভারতবর্ষেরই এক মন্দিরে আবার ইঁদুরকেই দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয়। সেখানে এরা পবিত্রই শুধু নয়, ইঁদুরের উচ্ছিষ্টই বিতরণ করা হয় প্রসাদ হিসেবে। স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যে রাজস্থানের এই মন্দির মন তো ভোলাবেই, তবে এই মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ কিন্তু এই ইঁদুরেরাই। শুনে নিন, সেই মন্দিরের গল্প।
রাজস্থানের করনিমাতা মন্দির। বিকানের থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরেই দেশনোক। সেখানেই রয়েছে মন্দিরটি। দেবী দুর্গারই এক অবতার বলে মনে করা হয় দেবী করনিকে। মজার ব্যাপার, ঠিক সেই ভাবে কোনও পুরাণের দেবী নন এই করনি। তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি।
চতুর্দশ শতকে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই করনি মাতা। তখন তাঁর নাম ছিল ঋদ্ধি বাই। কথিত আছে, চরণ পরিবারে বিয়ে হয় তাঁর। তবে সংসারে বেশিদিন মন বসেনি। নিজের বোন গুলাবের সঙ্গে স্বামীর বিয়ের ব্যবস্থা করে সংসার ত্যাগ করেন। বাকি জীবন সন্ন্যাসিনী বেশেই কাটিয়েছেন।
যোধপুর ও বিকানেরের রাজপরিবারের কাছে দেবীস্বরূপ ছিলেন করনি মাতা। জীবদ্দশাতেই দেবীত্ব অর্জন করেন তিনি, এবং তাঁর ভক্তের সংখ্যাও ছিল বহু। কিন্তু হঠাৎ একদিন হারিয়ে যান করনি মাতা। তাঁর রহস্যজনক অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান হয়নি আজও। কেউ মনে করেন, খুন করা হয়েছিল তাঁকে। ওই দুই রাজপরিবারে কিন্তু দেবী করনির প্রভাব ছিল অসীম। রাজ্য পরিচালনা থেকে শুরু করে নানাবিধ বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই করনি মাতার মতামতই ছিল শিরোধার্য। করনির অন্তর্ধানের পরে বিকানরে এই মন্দিরটি প্রতিষ্টা করেন রাজপরিবার।
আরও শুনুন: ইঁদুরের কামড়ে করোনা! রিপোর্ট হাতে চক্ষু চড়কগাছ তরুণীর
এই মন্দিরের ভিতরেই বাস ২০ হাজার ইঁদুরের। তাঁরা সকলেই দেবস্বরূপ। এদের নাম কাব্বাস। স্থানীয় বিশ্বাস, এরা সকলেই করনি মাতার সন্তান ও তাঁদের বংশধর। তাই এদের সাক্ষাৎ পেতেই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে ভক্তকুল। প্রসাদও নিবেদন করা হয় এদের উদ্দেশে। আর দৈবাৎ যদি একটি বা দুটি সাদা ইঁদুরের দেখা আপনি পেয়ে যান, তবে আপনার মতো ভাগ্যবান আর কেউই নন। কারণ স্থানীরা মনে করেন, সাদা ইঁদুর করনিমাতার নিজ গর্ভের সন্তান। কেন এমন বিশ্বাস? এর পিছনেও নাকি রয়েছে গল্প।
মনে করা হয়, করনি মাতার শত শত সন্তান ও তাঁর সৎ ছেলে লক্ষ্মণ কপিল সরোবরে জল খেতে গিয়ে ডুবে মারা যায়। সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে স্বয়ং যমরাজের শরনাণান্ন হন করনি মাতা। তাঁর অনুরোধে করনি মাতার সন্তানদের প্রাণভিক্ষা দেন যমরাজ। ইঁদুর হিসেবে সমস্ত সন্তানদের পুনর্জন্ম হয় এই পৃথিবীতে। তাই করনীমাতার মন্দিরে এই ইঁদুরেরা পুজ্য। শুধু পুজ্যই নয়, রীতিমতো মাথায় করে রাখা হয় তাঁদের। এমনকি ভুলবশত বা কোনওভাবে যদি কোনও একটি ইঁদুর আপনার পায়ের তলায় চলে আসে, তবে সেই ইঁদুরের সমপরিমাণ ওজন ও আকারের একটি সোনার ইঁদুর গড়ে মন্দিরকে দান করতে হবে আপনাকে। তেমনটাই নাকি প্রথা।
এই ইঁদুরদের নিয়ে আরও একটি গল্প কিন্তু প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, একবার নাকি প্রায় ২০ হাজার সেনা বিকানরের কাছাকাছি কোনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন দেশনোকে। আর সৈনিকদের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো গুরুতর অপরাধ, আর যার শাস্তি অবধারিত মৃত্যুদণ্ড। দয়াশীলা করনিমাতা তাঁদের প্রাণ কাড়েননি। তবে শাস্তিস্বরূপ তাঁদের ইঁদুরে রূপান্তরিত করে এই মন্দিরেই থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
আরও শুনুন: শক্তিপীঠের অন্যতম হিমাচলের জ্বালামুখী মন্দির, সাতটি শিখা এখানে নেভে না কখনও
এই মন্দিরে ইঁদুরই সাক্ষাৎ দেবদূত। তাই ভক্তের দেওয়া প্রসাদে ইঁদুর মুখ দেওয়া মানে তা মহা পুণ্যের ব্যাপার। এমনকি এখানে প্রসাদও মেলে ইঁদুরের উচ্ছিষ্টই। আর সেই প্রসাদ পেতে লম্বা লাইন পড়ে মন্দিরে। এই মন্দিরের দরজা খুলে যায় প্রতিদিন ভোর চারটের সময়। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধারতির সময় নাকি নিয়ম করে বেড়িয়ে আসে ইঁদুরসেনা। এমনটাই হয়ে এসেছে। নবরাত্রীর সময় প্রতিবছরই মন্দির চত্বরে ভিড় উপচে পড়ে। বছরে দুবার মেলাও বসে দেশনোকে। সেই মেলার নামও করনি মাতার নামে। করনি মেলা। প্রচুর ভিড় হয় সেখানেও।
সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি এই মন্দির ঐতিহ্যের দিক থেকেও যেমন পুরনো, তেমনই সুন্দর এর স্থাপত্য। মন্দির চত্বরের প্রধান ফটকে রয়েছে বিশাল এক সিংহমূর্তি। তার কানে কানে মনের ইচ্ছা বললেই নাকি তা পূরণ হবেই হবে, এমনই বিশ্বাস স্থানীয়দের। সম্প্রতি করনি মাতা মন্দিরের একটি সংগ্রহশালাও বানানো হয়েছে ওই চত্বরেই। সব মিলিয়ে দেশের অন্যতম আকর্ষণ এই মন্দির আর সেখানে ইঁদুরদের গুরুত্ব দেবতার চেয়ে কিছু কম নয়।