‘পৃথিবীটা পাখি গাছ মানুষ সবার’ … এই কথাটা সকলে ভুলতে বসলেও কার্তিক সত্যনারায়নের মতো অনেকে ঠিকই মনে রেখেছেন। তাঁদের মতো মানুষের জন্যই হয়তো আজও পৃথিবীতে জীববৈচিত্র কিছুটা হলেও বেঁচে রয়েছে। তিনি বনরক্ষক। নিজেকে এমনটাই ভাবতে পছন্দ করেন কার্তিক। জীবনের অধিকাংশ সময়টাই বন্যপ্রাণীদের জন্য বরাদ্দ করেছেন তিনি। প্রায় ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটাই তার পেশা ও নেশা। ভারতে তাঁকে অনেকেই বিয়ারম্যান বলে ডাকতে পছন্দ করেন। কী করে বিয়ারম্যান হয়ে উঠলেন এই কার্তিক সত্যনারায়ণ? আসুন, শোনা যাক তাঁর গল্পই।
বনের পাহারাদার তিনি। বন্যপ্রাণীদের রক্ষাকর্তা। এ ভাবেই নিজেকে দেখতে পছন্দ করেন কার্তিক সত্যনারায়ণ। ভারতে তাঁর পরিচয় বিয়ার-ম্যান বলেই। ছ-শোরও বেশি ভাল্লুককে বাঁচিয়ে এনে নতুন বাসস্থান দিয়েছেন তিনি।
ছোট থেকেই বনজঙ্গলের নেশা চেপে ধরেছিল কার্তিককে। বেঙ্গালুরুতে বাড়ির আশপাশের জঙ্গলগুলো চষে ফেলেছিলেন একটু বড় হতে না হতেই। কত জ্যোৎস্না-রাত যে জঙ্গলের মধ্যে গাছের ডালে বসে কাটিয়েছেন! একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই বিষয়ে হাতেখড়ি কার্তিকের। সেটা ছিল বাঘ নিয়ে একটি ফিল্ড রিসার্চ। সেই থেকে শুরু।
রাস্তাঘাটে বাঁদর বা ভাল্লুকের খেলা নিশ্চয়ই দেখেছেন! বহু দেশের মতোই ভারতেও দীর্ঘ দিন ধরে এই নিষ্ঠুর অমানবিক প্রথা চলে আসছে। বাঁদর বা ভাল্লুকের নাচ দেখে আমরা যত না মজা পাই, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি অত্যাচার সহ্য করতে হয় প্রাণীগুলিকে।
আরও শুনুন: নিখোঁজ শিশুদের খুঁজে পৌঁছে দেন বাড়ি, দেশবাসী কুর্নিশ জানায় এই আমলাকে
কালান্দর সম্প্রদায় বলে এদেশেরই এক জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকাই ছিল এই ভাল্লুক-নাচানো। পথে পথে ঘুরে স্লথ ভাল্লুক নিয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন এরা। একেবারে সদ্যজাত কিংবা ছোট ভাল্লুকগুলিকে মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে আনা হত। এর পরে সেই খুদে প্রাণীগুলোর নাক বরাবর পরিয়ে দেওয়া হত একটা দড়ি। আর সেটা এমন ভাবেই পরানো হত, যা টানলে রীতিমতো মরণযন্ত্রণা পেত ভাল্লুকছানাগুলি। ওই ভাবেই মালিকের কথা শুনতে বাধ্য করা হত তাদের। এর পর চলত প্রশিক্ষণ। ভেলকি দেখানোর ক্লাস।
চারশো বছরেরও পুরনো এই অমানবিক প্রথাকে দেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় লেগেছে কার্তিক ও তার দলের। ১৯৯৫ সালে গীতা সেশামানির সঙ্গে ওয়াইল্ড লাইফ এসওএস নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন কার্তিক। দীর্ঘদিন ধরে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের উপরে কাজ করে এসেছেন গীতা। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বন্যপ্রাণীদের বাঁচিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া। কার্তিক ও গীতা মিলে শুরু করলেন সেই কাজ।
আরও শুনুন: বৃক্ষরোপণ নেশা, ৪০ বছরে ১১ লক্ষেরও বেশি গাছ লাগিয়ে নজির জয়রামের
আর সেটা এতটাও সোজা ছিল না। কেবল মুখে বললেই যে ভাল্লুকের খেলা বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা তো নয়। কালান্দর সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন তাঁরা। ভাল্লুক ছাড়াও আর কী কী পথে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, সে সব নিয়ে আলোচনা করতেন। এমনকি মহিলাদের স্বনির্ভর করতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন, বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা, সবটাই করেছেন কার্তিকেরা। সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি কালান্দর শিশুকে স্কুলে পাঠাতে সফল হয়েছেন তাঁরা। আর সবচেয়ে মজার কথা কী জানেন, ওই সম্প্রদায়ের ৪০ শতাংশ মানুষই আজ কার্তিকের এসওএস দলের অংশ। একদিন যারা ভাল্লুকদের দিয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন, তাঁরাই আজ কার্তিকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্য পশুদের বাঁচান।
২০০৯ সালের পরে কালান্দর পরিবারে জন্মানো কোনও শিশুই বাড়িতে ভাল্লুক দেখেনি আর। অন্তত চার হাজারেরও বেশি কালান্দর পরিবার আজ বিকল্প রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছেন। আর বেআইনি ভাবে ভাল্লুক খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় না তাদের।
সে সমস্ত ভাল্লুকদের থাকা-খাওয়ার জন্য আগরা, বেঙ্গালুরু ও মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি পুনর্বাসন কেন্দ্র খুলেছেন কার্তিক ও তার দলবল। সেখানে রয়েছে এক হাজারেরও বেশি ভাল্লুক। স্লথ বিয়ারদের জন্য তৈরি পুনর্বাসনকেন্দ্রটি পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম ভাল্লুক সংরক্ষণ কেন্দ্র।
শুধু ভাল্লুকই নয়, হাতি, চিতাবাঘ থেকে শুরু করে নানা ধরনের সাপ, অ্যালিগেটরের মতো বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বেআইনি পাচার আটকানোর পাশাপাশি তাদের চিকিৎসা-সহ বেশ কিছু বিষয়আশয়ের খেয়াল রাখেন কার্তিকেরা। সব মিলিয়ে ভারতে মোট ১২টি বন্যপ্রাণ উদ্ধারকেন্দ্র রয়েছে তাঁদের।
বাকি অংশ শুনে নিন।