পৃথিবীর সংগ্রহশালায় বহু বিচিত্র জিনিসই জমা হয়ে আছে। আর মানুষের মগজে আছেই মোক্ষম অস্ত্র। অতএব সেই মগজের হালহদিশ পেতেই মানুষ মগজ খাটিয়ে গড়েছিল এই মগজের মিউজিয়াম। তাও আবার মানুষের স্বার্থেই। কিন্তু নেপথ্যে রয়েছে কোন কাহিনী? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
চালাক-চতুর স্মার্ট মানুষ। দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। কঠিন সমস্যা অনায়াসে সমাধান করে ফেলেন। এরকম কাউকে দেখলে বলতে ইচ্ছে করে, আয় দেখি তোর মগজটা ফুটোস্কোপ দিয়ে! ফেলুদার মগজাস্ত্র হোক বা মহেন্দ্র সিং ধোনির ঠান্ডা মাথার সিদ্ধান্ত- আমাদের বিস্মিত করে। বিশ্বের তাবড় স্রষ্টা, চিন্তকরা যখন তাঁদের সৃষ্টি এবং ভাবনায় বিশ্বকে আন্দোলিত করেন, তখনও আমজনতার একই প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মগজ তো আর দেখার জিনিস নয়। মগজের খেলা দেখলে বোঝা যায়, কার মগজের দৌড় কতদূর। মগজের জেরে মানুষ প্রাণীর জগতে শ্রেষ্ঠ। আবার মগজের জেরেই মানুষের রাজত্বে কতিপয় ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠেন। অতএব এই ব্রহ্মাণ্ডে মানুষের যাবতীয় আধিপত্যের কেন্দ্র যে ওই মগজটিই, তা বুঝতে আর বাকি থাকে না! তবে, সমস্যা একটিই। মগজ আর মাথা এক নয়। মাথা দেখা যায়, মগজ নয়। তা যেন এক আজব ভোজবাজি! তবে মানুষেরই বিশ্বে এমন একটা জায়গা আছে, যেখানে দেখা মিলবে মগজের। তা-ও আবার একটি দুটি নয়, ১০ হাজার মগজ বা মস্তিষ্ক।
:আরও শুনুন:
সমুদ্রের গভীরে যুদ্ধাস্ত্রের সমাধিক্ষেত্র, সার দিয়ে রাখে আছে কামান-ট্যাঙ্ক-বন্দুক, কেন জানেন?
আসলে এ হল মস্তিষ্কের সংগ্রহশালা। মানুষ তার ইতিহাসের যাবতীয় নিদর্শন সংগ্রহ করে রাখে। তা ধরেই মেলে বিবর্তনের রূপরেখা। আর তাই সংগ্রহশালা মানুষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সংগ্রহকারীদের যত্ন, পরিশ্রম দিয়ে অতীতকে বাঁচিয়ে রাখার দুর্মর চেষ্টা। সেই সংগ্রহের নমুনা দেখলেও তাজ্জব হতে হয়। তোমার মহাবিশ্বে যে কিছুই যায় না ফেলা, তা বোধহয় মিউজিয়ামই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। সেখানে মগজ বা মস্তিষ্ক তো মহার্ঘ। তা দিয়েও সংগ্রহশালা নির্মাণের কথা ভেবেছে মানুষ। নাহ্ কোনও কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি নয়। বাস্তবেই আছে এই মগজ-মিউজিয়াম।
:আরও শুনুন:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলাপ, দীর্ঘ ৭৮ বছর পর ৯২ বছরের প্রেয়সীকে খুঁজে পেলেন ৯৯ বছরের বৃদ্ধ
এই মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা আছে ডেনমার্কে, যেখানে ১০ হাজারের বেশি মানুষের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করা হয়েছে। এত সব মস্তিষ্ক কাদের? সে কথা বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৯৪৫ সালে। তখন সবেমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটেছে। ধীরে ধীরে সময়ের নিয়মে সব আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে যুদ্ধের আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বহু মানুষ। সে সময় ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছিল নানাবিধ মানসিক অসুখ। ডিপ্রেশন, আলঝাইমারস, স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো অসুখের শিকার হয়েছিল আমজনতা। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনকার মতো উন্নত ছিল না। তবে ব্রিটেন, ডেনমার্ক, বেলজিয়ামের মতো ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ এই বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। সেই সময় মানসিক রোগীদের স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা ভেবে, ১৯৫২ সালে ডেনমার্কে ‘রিসকভ’ নামে একটি মানসিক হাসপতাল গড়ে উঠেছিল। ওই হাসপাতালে ফরেন্সিক পরিক্ষার সময় মৃত ব্যক্তিদের দেহ থেকে মস্তিষ্ক বের করে নিয়ে, সংগ্রহ করে রাখা হত। তা করা হত গবেষণার খাতিরেই।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত গোপনে অবিরামে চলছিল গবেষণার এই কাজ। কিন্তু তারপরেই এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার ফলে, গবেষণা ঘিরে নানারকম প্রশ্ন উঠতে থাকে। ১৯৮৭ সালে ডেনমার্কে এ নিয়ে রীতিমতো তদন্ত পর্যন্ত হয়। আর সেই তদন্তেই সামনে আসে বিশ্বের বৃহত্তম মস্তিষ্ক সংগ্রহশালার কথা। পরবর্তীতে রিসকভ হাসপাতালে থেকে সংরক্ষিত মস্তিষ্কগুলিকে ইনস্টিটিউট অফ ব্রেন প্যাথলজিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং বর্তমানে সমস্ত মস্তিষ্ক সেখানেই সংরক্ষিত আছে।
পৃথিবীর সংগ্রহশালায় বহু বিচিত্র জিনিসই জমা হয়ে আছে। আর মানুষের মগজে আছেই মোক্ষম অস্ত্র। অতএব সেই মগজের হালহদিশ পেতেই মানুষ মগজ খাটিয়ে গড়েছিল এই মগজের মিউজিয়াম। তাও আবার মানুষের স্বার্থেই। মানুষের মগজের দৌড় যে কতদূর, এ নিয়ে তাই বোধহয় আর কোনও প্রশ্নের অবকাশই থাকে না।