গোটা গ্রামে মুসলিম বলতে একজন। তবে মসজিদ রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে নমাজপাঠ হয়। নিয়মমাফিক আজান দেওয়া হয়। শোনার মত কেউ নেই জেনেও, প্রতিদিন এই কাজ করেন গ্রামের ওই একমাত্র মুসলিম বাসিন্দা। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
কেউ শুনবে না। তবু নিয়ম করে আজান (Azaan) দেন গ্রামের একমাত্র মুসলিম বাসিন্দা। শুনতে অবাক লাগলেও বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এমন দৃশ্যই ধরা পড়ে। মনে পড়ে যায় কবিগুরুর সেই চেনা গানের লাইন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে!
চলার পথে কারও সঙ্গ না পাওয়াটা ব্যক্তিগত পছন্দ নাও হতে পারে। ব্যাপারটা কয়েকদিন ঘুরতে যাওয়ার হলে একরকম, কিন্তু সারাজীবনের জন্য কেউই একা থাকতে চান না। কখনও পরিস্থিতি বাধ্য করে, কখনও অন্য কিছু। এক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। গ্রামে অন্তত ৩৫০ বেশি বাসিন্দা। কিন্তু তার মধ্যে মুসলিম মাত্র একজন। তাতে সমস্যার কিছু নেই। কারণ গ্রামের একমাত্র মুসলিম বাসিন্দাকে আলাদা নজরে দেখেন না হিন্দুরা। আক্ষেপ বলতে, তিনি বড্ড একা।
কথা বলছি জাহিদ আনসারি (Zahid Ansari) সম্পর্কে। বিহারের নালন্দা জেলার কাছে সরবহেদি গ্রামের (Sarbahdi Village) বাসিন্দা। বয়স আন্দাজ চল্লিশের ঘরে। আলাদা কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। গ্রামেই কাটান সারাদিন। কাজ বলতে গ্রামের একমাত্র মসজিদে গিয়ে আজান দেওয়া। নিয়ম করে দিনে পাঁচবার। আর তারপর গ্রামের খুদেদের টিউশন পড়ানো। আপাতভাবে আনসারির কাজ বা রোজের রুটিন শুনলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সরবহেদির মতো হিন্দুপ্রধান গ্রামে তাঁর এই কাজ বেশ অবাক করার মতোই। আনসারি ভালোমত জানেন তাঁর আজান শোনার মতো কেউ নেই। অথচ নিজের কাজে এতটুকু ফাঁকি দেন না কখনও। প্রতিদিন যথাসময়ের হাজির হন মসজিদে। নমাজ সেরে আবার ফিরে যান। গ্রামের হিন্দুদের এই নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। সকলেই আনসারির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন। আনসারি নিজেও কোনও ঝামেলায় জড়ান না। নিজের কাজটাকে দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন আর তা পালন করার চেষ্টা করেন।
মুসলিম সমাজে এরা মুয়াজ্জিন নামে পরিচিত। যাদের কাজ, প্রতিদিন সময়মতো মসজিদে গিয়ে সকলকে নমাজের জন্য ডাক দেওয়া। দীর্ঘদিন আনসারির বাবা আবদুল সামাদ এই কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন আনসারি। একসময় এই গ্রামেও বহু মুসলিম পরিবারের বাস ছিল। তবে সবকিছু বদলে দেয় ১৯৮১-র সাম্প্রদায়িক অশান্তি। এতটাই বীভৎস পরিস্থিতি তৈরি হয় যে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন মুসলিমরা। কেউ কেউ বিহারের অন্য অংশে কেউ আবার বাংলায় পালিয়ে আসেন। ঘর-বাড়ি, জমি-জায়গা সবকিছু বেদখল হয়ে যায় রাতারাতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নিজেদের গ্রামে আর ফিরে আসেনি কোনও মুসলিম পরিবার। ব্যতিক্রম আনসারির পরিবার। কার্যত মুসলিমশূন্য গ্রামে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা। এখন অবশ্য আনসারি পরিবারেও কেউ জীবিত নেই। বাবার মৃত্যুর পর জাহিদ আনসারির একার সংসার। বিয়ের পরামর্শ পেলেও, সে পথে পা বাড়াননি। নিজের মতো করে জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছেন। গ্রাম ছাড়ার কথা যে তিনিও ভাবেননি এমন নয়, তবে শেষমেশ তা হয়ে ওঠেনি। আর এখন তো প্রশ্নই ওঠে না গ্রাম ছাড়ার। কারণটা ওয়াকফ সংশোধনী বিল।
নতুন বিলে যে কয়টি সংশোধন আনা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর। অর্থাৎ দীর্ঘদিন কোনও ওয়াকফ সম্পত্তি কেউ ব্যবহার না করলে তা সরকারের দখলে চলে যাবে। এই ভয় থেকেই গ্রাম ছাড়ার কথা ভুলেছেন আনসারি। সরবহেদি গ্রামে মসজিদ, কবরস্থান সহ বেশ কয়েক বিঘা জমি রয়েছে ওয়াকফের আওতায়। আনসারি একমাত্র মুসলিম বাসিন্দা হলেও সেসব ব্যবহার করেন। তাই সরকারি হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই। তাই একা হলেও নিজেকে নিয়ে তেমন ভাবেন না আনসারি। যেমন চলছে সেভাবেই আগামী দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান। মসজিদের পাশের জমিতেই চিরঘুমে শুয়ে আছেন তাঁর বাবা। সেখানেই মৃত্যুর পর সমাধিস্থ হতে চান। তার জন্য একা একা অপেক্ষা করতে হোক তাই সই!