রাস্তার দু-ধারে ছড়িয়ে কঙ্কাল। দিনের বেলাতেও এ পথে যাওয়ার সাহস হয় না অনেকের। সিনেমা নয়, বাস্তবেই রয়েছে এমন জায়গা। কোথায় জানেন?
আকাশ ছেয়ে গেছে নিকষ কালো অন্ধকারে। পথের মাঝে ইতিউতি দাঁড়িয়ে আছে দু-একটা মৃত গাছ। হঠাৎ করেই মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে গেল একদল বাদুড়। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই পায়ে কী যেন ঠেকল! কী ঠেকল জানার জন্য নিচু হওয়া মাত্রই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। এ যে একটা আস্ত খুলি!
এতদূর শুনে কী মনে হচ্ছে? নিশ্চয়ই কোনও হরর মুভির সেট! অথবা ভাবছেন এ বোধহয় কোনও অলৌকিক গল্পের প্রেক্ষাপট? না, এ আদৌ কোনও গল্প নয়। এ যেন একেবারে সত্যি কথা। এ এক মৃত শহরের কথা।
উত্তর চিলির ‘আটাকামা’ মরুভূমির পাশেই রয়েছে কর্ডিলেরা পর্বতশ্রেণি। আর তার ঠিক পাদদেশে রয়েছে এই মৃত্যুপুরী। নাম ‘লা নোরিয়া’।এক সময় এখানেই ছিল আস্ত একটা শহর। দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকতেন এখানকার মানুষ। আরও পাঁচটা শহরের মতোই এ শহরও চিৎকার-চেঁচামেচি, হই-হট্টগোলে ছিল জমজমাট। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, পেরু দখল করার পর স্প্যানিশরা ১৫৫৬ সালে অনুমান করে যে, ওই এলাকায় আছে পটাশিয়াম নাইট্রেটের ভাণ্ডার। ১৮২৬ সালে, ফরাসি ব্যবসায়ী হেক্টর ব্যাকুয়ে সেখানে তৈরি করেছিলেন ‘ডে লা নোরিয়া’ সল্টপিটার প্ল্যান্ট। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এখানে তিনি প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম নাইট্রেট উৎপাদন করতে শুরু করেন। পটাশিয়াম নাইট্রেট বারুদ তৈরিতে কাজে লাগে। আর তাই ইউরোপীয় বাজারে তখন ছিল বারুদের ব্যাপক চাহিদা। কিছুদিনের মধ্যেই ঘটে অঘটন।
সালটা ছিল ১৯৩০। বিষাক্ত নাইট্রেট বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় চিলির পুয়েলেমা নাইট্রেট ক্যাম্প। মৃত্যু হয় শহরের নাগরিকদের। আর এরপরেই ধীরে ধীরে ওই ক্যাম্প হয়ে ওঠে অপরাধীদের আখড়া। কারণ অপরাধীদের ধারণা হয় এ অঞ্চলে নাকি লুকিয়ে আছে পেরুর রত্নভাণ্ডার। যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা তোলপাড় করেছিল ‘লা নোরিয়া’ শহর। সমাধিক্ষেত্র খুঁড়ে তুলে ফেলেছিল শয়ে শয়ে কফিন। কফিনের ঢাকনা ভেঙেও তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছিল সেই গুপ্তধন। আর তারপর? তারপর সেখানে শুধুই পড়ে আছে কঙ্কাল। বিশ্বের ঐতিহাসিক ভুতুড়ে শহরগুলির মধ্যে প্রথম সারিতেই রয়েছে চিলির পুয়েলেমা নাইট্রেট ক্যাম্পের নাম।
তারপর ধীরে ধীরে এই শহর কিছু অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় পর্যটকদের নজরে আসে। অস্কার মুনোজ, ২০০৩ সালে ‘লা নোরিয়া’য় খুঁজে পেয়েছিলেন একটি কঙ্কাল। হাজার অনুসন্ধানের পরেও সেই কঙ্কালের কোনও ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর থেকেই বহু পর্যটক যেতে শুরু করেছেন লা নোরিয়াতে। যদিও ‘লা নোরিয়া’ শহরে পৌঁছনো মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এই পরিত্যক্ত শহরে যাওয়ার প্রধান রাস্তাটিই বন্ধ। তাই কিছুটা পাহাড়ি রাস্তায়, কিছুটা বালিয়াড়ির উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এগোতে হয় শহরের দিকে। একটা সময় পর গাড়ি চালানোর রাস্তাও থাকে না। তখন শুরু করতে হয় হাঁটা। পাঁচ কিলোমিটার এক নাগাড়ে হাঁটার পর শহরে ঢোকা যায়। আর ঢুকেই পর্যটকরা আঁতকে ওঠেন। একটা-দুটো নয়, শয়ে শয়ে ভাঙা কফিন আর কঙ্কালে পড়ে রয়েছে শহরের পথে-পথে। শহরের শুনশান রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের হাড়গোড়।
পর্যটকরা সাধারণত ‘লা নোরিয়া’র রাস্তা দিয়ে দিনের বেলা হাঁটতে ভয় পান। চারিদিক নিস্তব্ধ, তাই নিজের পায়ের শব্দেই নিজের চমক লাগতে পারে। তবুও সাহসী পর্যটক কেউ কেউ পিছু হটেন না। পর্যটকরা যাঁরাই রাতে থেকেছেন, তাঁরাই নাকি শুনেছেন, এই শহরের অলিতে গলিতে রাতে শোনা যায় মানুষের আর্তনাদ। অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে আসে কঙ্কালের হাঁটার খটখট শব্দ। পচা মাংসের দুর্গন্ধে নাকি টেকা দায় হয়ে ওঠে। এমনকী ঘাড়ের পাশে অচেনা কারও গভীর দীর্ঘশ্বাসও কেউ কেউ নাকি স্পষ্ট অনুভব করেন।
একুশ শতকের আধুনিক মনের আতশকাচে এই ধরনের কথাকে আষাঢ়ে গল্প বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবুও সেই অ-দেখাকে দেখার জন্য গা ছমছম করা অভিজ্ঞতার লোভে এই শহরে ছুটে যান পর্যটকেরা। আর ইতিহাসের এক অমীমাংসিত আখ্যান হিসেবে রয়ে যায় মৃত শহর ‘লা নোরিয়া’।