এবছর তার দেখা নেই। গরমের পারদ যতই চড়ুক, কালবৈশাখী আসছে না তা শান্ত করতে। নেই ছিটেফোঁটার বৃষ্টির পূর্বাভাস। এমনকী আগামী এক মাসেও বৃষ্টি বা ঝড়ের দেখা মিলবে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারছেন না আবহবিদরা।
সন্ধে হতে ঢের বাকি। কিন্তু আকাশ দেখে বোঝার জো নেই। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। গাছের পাতা অবশ্য শান্ত। রাস্তা দিয়ে জোর প্যাডেলে ছুটে গেল সাইকেল। এদিক ওদিক কেউ নেই বললেই চলে। এমনকি রাস্তা থেকে কুকুর, বিড়ালও উধাও। হঠাৎ দমকা হাওয়া। ধুলোর ঝড়। গাছের পাতায় সোঁ সোঁ শব্দ। ঘরের একটা জানলা বেখেয়ালে খোলা ছিল। সশব্দে তা বন্ধ হল। তখনও বিছানায় অর্ধেক খোলা ‘আম আঁটির ভেঁপু’। দুগগাদিদির কথামতো অপুও ছুটেছে আম কুড়োতে। দিদির মতো অত আম কুড়নোর সাধ্য তার নেই। তাই একটা দুটো কুড়িয়েই সে দিদিকে বলে, ‘দ্যাখ কত বড়’। দিদি-ভাইয়ের সেই ভালোবাসা পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয় গ্রামবাংলার একেবারে অন্দরমহলে। সেখানে কালবৈশাখীর ঝড় আর আম কুড়োতে যাওয়া প্রায় সমার্থক।
গ্রামবাংলার এই কালবৈশাখীর সঙ্গে শহুরে ঝড়ের তফাৎ অনেক। এখানে আম গাছ থাকলেও, আম কুড়োনোর লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। মফস্বলে তাও বা হতে পারে। তবে খাস কলকাতায় ঝড়ের বিকেল একেবারেই আলাদা। শুনশান রাস্তাঘাট। কোনওক্রমে ঘরের একটা জানলা সামান্য ফাঁক করে ঝড় দেখছে ক্লাস নাইন। ঝড় একটু কমলে সেও বৃষ্টি ভিজতে ছাদে যাবে। থাকুক পরীক্ষা, প্রথম বৃষ্টিতে একটু না ভিজলেই নয়!
আসলে, শহর হোক বা গ্রাম, প্রথম বৃষ্টির আনন্দটা কোথাও গিয়ে যেন এক। ঝড় যতই ক্ষতি করুক, কালবৈশাখী বরাবর ডাক পেয়েছে গানে-কবিতায়। পুরনো কথা মনে পড়ে। খুব বেশি নয়, বছর খানেক আগে ফিরলেই বছরের এই সময়টায় অনেক ঝোড়ো বিকেল খুঁজে পাওয়া যেত। কলেজ থেকে ফেরার পথে ধুলোর ঝড়। কোনওক্রমে বাসে উঠতে হবে। নাহলে রাস্তার একধারে অপেক্ষা। কতক্ষণে বৃষ্টি নামবে। পিচ রাস্তার সোঁদা গন্ধ নেই। তবে কিছু একটা আছে। যা মেঠো পথের বৃষ্টিভেজা গন্ধের মতোই মিষ্টি। ধুলোবালি থাকলেও, বৃষ্টি সেসব ধুয়ে দেবে। রং বদলাবে গাছের পাতা। বৃষ্টি থামলে দেখা মিলতে পারে রামধনুও। অন্ধকার কেটে নতুন করে আলোর দেখা। একটু পরেই অস্ত যাবে সূর্য। এমনিই অন্ধকার হবে চারদিক। তবু ঝড়ের শেষে গোধূলিবেলার সেই অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ ভোলার সাধ্য নেই।
তবে, এবছর তার দেখা নেই। গরমের পারদ যতই চড়ুক, কালবৈশাখী আসছে না তা শান্ত করতে। নেই ছিটেফোঁটার বৃষ্টির পূর্বাভাস। এমনকী আগামী এক মাসেও বৃষ্টি বা ঝড়ের দেখা মিলবে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারছেন না আবহবিদরা।
বিগত কয়েকবছরে গরম বেড়েছে রেকর্ড হারে। চলতি বছরও ব্যতিক্রম নয়। গরমের চোটে নাজেহাল বাংলা। তবে অন্যান্য বছর এতদিনে অন্তত একবার ঝড়বৃষ্টির দেখা মেলে। এবার সে বালাই নেই। চাঁদিফাটা গরমে ধুঁকছেন সকলেই। কারণ হিসেবে পশ্চিম থেকে বয়ে আসা শুকনো এবং গরম হাওয়াকেই দায়ী করছে হাওয়ামহল। এই পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কারণেই রাজ্যে শীত সেইভাবে আসতে পারেনি বলে শোনা গিয়েছিল। গরমের বাড়বাড়ন্তের কারণও নাকি সেই পশ্চিমের হওয়াই। গরমে ঘাম হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। এমনটা হয় আর্দ্রতার কারণে। অর্থাৎ বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি। আর সেই আর্দ্রতার ফলে বিকেলের দিকে ঝড়-বৃষ্টি হত। যাকে কালবৈশাখী নামেই চেনে বাঙালিরা। তবে এবছর গরম রয়েছে, ঘামও রয়েছে, নেই শুধু বিকেলের ওই ঝড়। পশ্চিমী ঝঞ্ঝাকে দায়ী করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও আশঙ্কা আবহবিজ্ঞানীদের। যেভাবে ক্রমাগত জলবায়ু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, তার প্রভাবে এই ধরনের সমস্যা হতেই পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। সেইসঙ্গে জুটেছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। গরমের বাড়বাড়ন্তে তার অবদানও কম নয়। কাজেই আগামীদিনেও যে গরম খুব একটা কমবে এমনটা না ভাবাই ভালো। আবহবিদরা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি হবে না এমনটাই ধরে নেওয়া হোক। কাজেই কালবৈশাখীর দেখাও মিলবে না সহজে। রইল পড়ে ঝড়ের মাঝে আম কুড়নো, সেসব রূপকথার গল্প ভেবে নেওয়াই ভালো!