কাউকে সাক্ষী রেখে কোনও কাজ করলে ব্যবহার করা হয় সাক্ষী গোপাল কথাটি। আবার ওড়িশার কটক শহরে রয়েছে সাক্ষী গোপালের একটি মন্দির। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, প্রচলিত বাগধারার সঙ্গে কি সেই মন্দিরের কোনও যোগসূত্র আছে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বাংলা ভাষায় বেশিরভাগ বাগধারার জন্ম হয়েছে তার পারিপার্শ্বিক লৌকিক আচার থেকে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উদাহরণ তৈরি করার মতো ঘটনা ঘটলেই, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একের পর এক মনোগ্রাহী বাগধারা। ঠিক সেরকম, দৈবের সঙ্গে মিল রেখেও বেশ কিছু বাগধারার প্রচলন ঘটেছে বাংলা ভাষায়। ‘সাক্ষী গোপালের’ জন্ম-ও ঠিক তেমনই এক কিংবদন্তির হাত ধরেই।
আরও শুনুন: দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে নাকি অগ্রণী তিনি, কীভাবে জন্ম হয়েছিল দেবর্ষি নারদের?
ওড়িশার সাক্ষী গোপাল মন্দিরটি বর্তমানে জনপ্রিয় এক পর্যটন ক্ষেত্র। পুরীর মন্দিরে ঘুরতে এসে অনেকেই দর্শন সেরে যান এই মন্দিরের ‘গোপালের’। কিন্তু সেই বিগ্রহকে ঘিরে যে এমন অদ্ভুত কিংবদন্তি লুকিয়ে রয়েছে তা বোধহয় অনেকেরই অজানা। শোনা যায় এই মন্দিরের বিগ্রহটি আগে ছিল বৃন্দবনের এক মন্দিরে। সেখান থেকে স্বয়ং ওড়িশার এই স্থানে এসেছিল ওই মূর্তি। আর এই মূর্তির নিজে পায়ে আসার ঘটনাটি ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এক কাহিনি। বলা বাহুল্য সেই কাহিনির মাধ্যমেই জন্ম হয়েছে সাক্ষী গোপাল বাগধারাটি।
তৎকালীন সমাজে চতুরাশ্রমের প্রয়োগ ভীষণভাবে প্রকট ছিল। যার শেষ পর্ব ছিল বাণপ্রস্থ। এই পর্বে উপস্থিত হলে যে কোনও ব্যক্তি সংসার ছেড়ে বনের পথে পাড়ি দিতেন জীবনের শেষ সময়টুকু কাটানোর জন্য। তেমন ভাবেই দক্ষিণ ভারতের এক কুলীন ব্রাহ্মণ সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজের ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তীর্থদর্শনে বেরিয়ে পড়েন। গয়া, কাশী, প্রয়াগ দর্শন করে তিনি মথুরায় এসে পৌঁছন। তার সঙ্গে একজন যুবক ব্রাহ্মণের আলাপ হয়। শান্ত স্বভাবের সেই যুবক সহজেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মন জয় করে নেন। তাঁরা একসঙ্গে মিলেই ঘুরে দেখতে থাকেন বৃন্দাবনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। হঠাৎ করেই ব্রাহ্মণের মনে হয় এমন ছেলে তাঁর কন্যার জন্য একেবারে উপযুক্ত পাত্র। তৎক্ষণাৎ নিজের মনের কথা সেই যুবককে বলেন ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণত্বের বিচারে সেই যুবক কুলীন ছিল না, তাই প্রাথমিক ভাবে এমন প্রস্তাবে অসম্মতি জানায় ওই যুবক। তার যুক্তি ছিল, এই বিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজ কিছুতেই মেনে নেবে না। তখন ওই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ যুবককে আশ্বস্ত করেন যে এমন কোনও পরিস্থিতি তিনি তৈরি হতে দেবেন না। তখন তাঁরা দুজনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃন্দাবনের এক গোপাল মন্দিরে। ব্রাহ্মণ সেই মন্দিরের দেবতাকে সাক্ষী করে শপথ করেন যে তিনি তাঁর কন্যার বিবাহ ওই যুবকের সঙ্গেই দেবেন। যুবকটিও কিছুদিন সময় চেয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যায়।
এদিকে মেয়ের জন্য সুপাত্র ঠিক করে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে আসেন ওই ব্রাহ্মণ। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় সেই পাত্রের পরিচয় সকলে জানার পর। ব্রাহ্মণের নিজের পরিবার থেকে আরম্ভ করে তাঁদের সমাজের প্রত্যেকেই এই বিয়ের বিরুদ্ধে একেবারে বেঁকে বসেন। ফলত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পড়েন এক ভয়ানক ধর্মসঙ্কটে। একদিকে তাঁর প্রতিজ্ঞাভঙ্গের ভয়, অন্যদিকে সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা। এমন সময় হঠাৎই সেখানে হাজির হন সেই যুবক। কিন্তু তাঁকে চরম অপমান করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেন ওই বৃদ্ধের আত্মীয়রা। অপমানিত যুবক গ্রামবাসীদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, যে মন্দিরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই মন্দিরের বিগ্রহকেই তিনি সাক্ষী হিসেবে সকলের সামনে নিয়ে আসবেন।
আরও শুনুন: কৌশিকী অমাবস্যায় আবির্ভূত হন দেবী তারা, কী মাহাত্ম্য এই তিথির?
মনের দুঃখে যুবক হাজির হন বৃন্দাবনের সেই মন্দিরে। কথিত আছে, সেখানে গিয়ে আকুলভাবে তিনি দেবতাকে জানান তাঁর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের কথা। সেই ডাকে নাকি সাড়াও দেন স্বয়ং গোপাল। যুবকের কথামতোই পাথরের বিগ্রহ রূপে তিনি সাক্ষী দিতে রওনা হন দক্ষিণ ভারতের ওই গ্রামের উদ্দেশে। তবে শর্ত ছিল, যাওয়ার পথে যুবক যেন পিছন ফিরে মূর্তির দিকে না দেখে। একবার পিছন ঘুরে তাকালেই গোপাল আর সামনে এগোবেন না। শর্ত মেনেই শুরু হয় যাত্রা। বেশ খানিকটা পথ যাওয়ার পর ওড়িশার কাছাকাছি একটি গ্রামে এসে যুবকের মনে হয় গোপালের বিগ্রহ আর সঙ্গে আসছেন না। সন্দেহের বশেই একটিবারের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে যান তিনি। কিন্তু ফল হয় উল্টো। শর্তমতো গোপাল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েন। এদিকে বৃন্দাবনের প্রস্তররূপী গোপাল এতদূর হেঁটে এসেছেন শুনে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ ওড়িশার ওই গ্রামে জমায়েত হতে থাকেন। খবর পৌঁছায় সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বাড়িতেও। তিনিও সদলবলে সেই গ্রামে উপস্থিত হন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে সেই যুবকের বিয়ের আয়োজন করেন সকলে। এই ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়তেই গোপালের নামে ওই স্থানে একটি মন্দির বানিয়ে দেওয়া হয়। এবং এই গোপালের বিগ্রহ পরিচিত হয় ‘সাক্ষী গোপাল’ নামেই।