ভোটপ্রচারের সময়ই একটি সাক্ষাৎকারে দাবা খেলার প্রতি আকর্ষণের কথা জানিয়ে কাসপারভকে তাঁর ‘প্রিয় দাবাড়ু’ বলেছিলেন রাহুল। পাশাপাশি, দাবা এবং রাজনীতির লড়াইয়ের তুলনাও টেনেছিলেন তিনি। মজার কথা হল, কাসপারভ নিজেও চৌষট্টি খোপের লড়াই থেকে অবসর নিয়ে পা রেখেছেন রাজনীতির পথে। দাবা খেলার শখ রয়েছে অমিত শাহেরও। কিস্তিমাতের চালে রাজনীতি আর দাবার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
দুই রাজা বসে বসে দাবা খেলে চলেছেন। আর তাঁদের বাইরের দুনিয়াটায় ঘটে যাচ্ছে ক্ষমতার হাতবদল। সরে যাচ্ছে গদি। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবি দেখিয়েছিল, গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে আসলে এক দাবাখেলাই চলছে। চারচৌকো বোর্ড থেকে সে খেলা নেমে এসেছে বাস্তবের মাটিতে। বাস্তবের সে খেলার নিয়ম না-জানা, না-বোঝা মানুষেরা বোর্ডেই আটকে পড়েছে অসহায়ের মতো। বানানো খেলায় তাদের হাতে মসনদ উলটে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, আর বাস্তবে তারা ঠিক নিধিরাম সর্দারের মতোই ক্ষমতাহীন। ঠিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভোট দেওয়া সাধারণ মানুষের মতোই। এখানে মসনদ বদলের রাজনীতির প্রতীকী হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই দাবাখেলা। আসলে চৌকো বোর্ডে হিসেব করে দেওয়া চালেই যে গদি উলটে দেওয়া যায়, দাবা খেলাই সে কথা শিখিয়েছিল। তাই রাজনীতি প্রসঙ্গে বারে বারেই উঠে আসে দাবার অনুষঙ্গ। সম্প্রতি রাহুল গান্ধী আর গ্যারি কাসপারভ-এর কথার সূত্র ধরে আরও একবার, রাজনীতির প্রাঙ্গণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল চৌষট্টি ঘরের এই খেলা।
রাজনীতির পাশাপাশি দাবা খেলতে ভালবাসেন রাহুল। এমনকি গর্ব করে দাবি করেও থাকেন যে, ভারতের সব রাজনীতিকদের মধ্যে এই খেলায় তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। সম্প্রতি ভোটপ্রচারের সময়ই একটি সাক্ষাৎকারে দাবা খেলার প্রতি আকর্ষণের কথা জানিয়ে কাসপারভকে তাঁর ‘প্রিয় দাবাড়ু’ বলেছিলেন রাহুল। পাশাপাশি, দাবা এবং রাজনীতির লড়াইয়ের তুলনাও টেনেছিলেন তিনি। মজার কথা হল, কাসপারভ নিজেও চৌষট্টি খোপের লড়াই থেকে অবসর নিয়ে পা রেখেছেন রাজনীতির পথে। এবার গান্ধী-নেহরু পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের রাজনীতিককে দাবার চাল মেনেই রাজনীতির চাল দেওয়ার কথা মনে করালেন ‘সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার’। দাবা খেলা সাধারণত শুরু হয় বোড়ের চালে। কারণ বোড়ে না এগোলে ঘোড়া ছাড়া আর কেউই ঘর ছেড়ে এগোতে পারে না। সেই ইঙ্গিতেই কাসপারভ বুঝিয়েছেন, ছোট ছোট ধাপেই বড় জয়ের দিকে এগোতে হয়। তাই কেন্দ্রে পৌঁছতে গেলে আগে রায়বরেলি জয় করা জরুরি।
এদিকে রাহুলের একটি ভিডিও পোস্ট করে রাজনীতির সঙ্গে দাবা খেলার অনুষঙ্গ টেনেছিল কংগ্রেস শিবিরও। তাদের বক্তব্য, দাবা খেলার মতোই, একাধিক পালটা চাল আগে থেকেই ভেবে রাখেন রাহুল। আর সে কারণেই তিনি প্রতিপক্ষের থেকে এগিয়ে। রাহুলেরও বক্তব্য, দাবা খেলায় প্রতিপক্ষের চাল বুঝে নিজের চাল স্থির করে নিতে হয়, যাতে প্রতিপক্ষের ঘুঁটিকেও নিজের সুবিধামতোই ব্যবহার করে ফেলা চলে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনীতির ক্ষেত্রে এহেন ঘটনা একেবারে মাস্টারস্ট্রোক। কেবল রাহুল কেন, যে কোনও পাকা রাজনীতিকই অন্য পক্ষকে নিজের কাজে লাগিয়ে বিপক্ষকে সাবোটাজ করতে চাইবেন।
সে কারণেই কি না কে জানে, দাবা খেলার শখ রয়েছে অমিত শাহেরও। মোদির উত্থানের নেপথ্যে, বলা ভালো দেশজুড়ে বিজেপির আধিপত্য কায়েম করার নেপথ্যে গেরুয়া শিবিরের এই ধুরন্ধর রাজনীতিকের ভূমিকা যে ঠিক কতখানি, সে কথা ওয়াকিবহাল মহল ভালোই জানে। মাসকয়েক আগেই সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছিল তাঁর দাবা খেলার একটি ছবি। যার ক্যাপশনে তিনি লিখেছিলেন, ভালো চাল দিয়েই থেমে যেয়ো না, আরও ভালো চালের কথা ভাবো। বিজেপি যে গত লোকসভার ৩০৩ আসনের স্মৃতি পেরিয়ে চারশো পারের ধুয়ো তুলেছে, সেই স্লোগানের ইঙ্গিতই যেন মেলে এই ক্যাপশনে। যদিও সাদা ঘুঁটির বিরুদ্ধে সাদা ঘুঁটির চাল কীভাবে দিচ্ছেন শাহ, কংগ্রেস তা নিয়ে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। তবে বিজেপির বিরুদ্ধে যেভাবে অন্য দলে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট টানার অভিযোগ ওঠে, তাতে এ ছবিই বা অবাক করবে কেন!
চলতি লোকসভা ভোটেই সপা-র শীর্ষ নেতা অখিলেশ যাদবকে আক্রমণ করতে দাবার সূত্র টেনেছিলেন রাষ্ট্রীয় লোক দলের সুপ্রিমো জয়ন্ত চৌধুরী। বলেছিলেন, নিজেদের কুইন অর্থাৎ মন্ত্রী খুইয়ে আমাদের রাজাকে চেকমেট করতে চাইছেন অখিলেশ। জানা কথা, দাবা খেলায় সবচেয়ে দামি ঘুঁটির নাম মন্ত্রী। তাই কোনও দলই খেলায় মন্ত্রী খোয়াতে চায় না। তাতে জয়ের সম্ভাবনা কমে যায় অনেকটাই। কিন্তু ছল করে মন্ত্রী খুইয়ে দুর্বল সাজার ভান করা বড় রাজনৈতিক চালই বটে। আর সেই চালেই হতে পারে কিস্তিমাত।
আসলে রাজনীতির দাবা খেলা এ দেশ দেখছে চিরদিনই। সে খেলার প্রতিপক্ষ বদলে বদলে গিয়েছে কেবল। তাই রাজনীতির ময়দানেও বারে বারেই রং চড়িয়েছে দাবা খেলার প্রসঙ্গ। সাম্প্রতিক ঘটনা সে তালিকায় নয়া সংযোজন মাত্র।