রাম জন্মভূমিতে রামলীলা, তার আয়োজক এক মুসলিম যুবক। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। ভারতের বুকে অন্য ভারতের দেখা মেলে এখানেই। নেপথ্যে কোন ভাবনা?
যেন এক অন্য ভারত। এ দেশে দ্বেষের লেশমাত্র নেই। রয়েছে স্রেফ মিলেমিশে থাকার অঙ্গীকার। ধর্মকে কেন্দ্র করে যে ভেদাভেদের রাজনীতি, তা এখানে গল্পকথা। তাইতো এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের চাইতেও বেশি সংখ্যায় মুসলিম দর্শকেরা ভিড় করেন রামলীলা দেখবার জন্য।
এই রামলীলার মূল আয়োজক সৈয়দ মাজিদ আলি। ধর্মে মুসলিম। তাও রামলীলা আয়োজনে সমস্যা বা আপত্তি নেই। বরং বাবার স্মৃতি আকড়ে বছরের পর বছর ধরে এই কাজ করে চলেছেন। ইনিও অযোধ্যার বাসিন্দা। সেই হিসাবে রামের সঙ্গে বিশেষ যোগ, এমনটা বলাই যায়। পেশায় চিকিৎসক সৈয়দ যোগীরাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর নির্ধারিত জাতীয় প্রকল্পের অধীনে কাজ করেন। বছরের বাকি সময়টা একরকম অনাড়ম্বর কেটে গেলেও, রামনবমীর আগে তাঁর দেখা মেলা ভার। কারণ? এলাকার সবচেয়ে বড় ‘রামলীলা’র আয়োজক ‘মুমতাজ নগর রামলীলা রামায়ণ সমিতি’র কর্ণধার তিনি!
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও গল্পটি সরবৈব সত্যি! সাত দিন ধরে টানা চলে এই অনুষ্ঠান, ভালো ও মন্দ চরিত্রদের ভূমিকায় সদর্পে মঞ্চ কাঁপান হিন্দু ও মুসলিম কলাকুশলীরা। দর্শকাসনেও মুসলিমরাই সংখ্যায় বেশি। তবে মাজিদবাবু খেয়াল রাখেন, মুখ্য চরিত্রগুলির পার্ট-এ অভিনয় করবার সুযোগ যেন হিন্দু শিল্পীদের কাছেই যায় কেবল! এর অন্য আর একটি কারণ হল, ইসলাম ধর্মে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। আর ‘মুমতাজ নগর রামলীলা রামায়ণ সমিতি’র উদ্দেশ্য কারুর ভাবাবেগেই আঘাত করা নয়। ফলে অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই সামান্য অনুভূতিপ্রবণ বিষয়গুলির উপর নজর রাখতেই হয়।
চাঁদা সংগ্রহ করা, অভিনেতা বাছাই করা থেকে শুরু করে তাঁদের রিহার্সাল করানো ও মঞ্চ সজ্জার কাজ, অর্থাৎ আয়োজনের সমস্তটাই মাজিদ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করেন। এটি তাঁর কাছে কেবলমাত্র সাধারণ কোনও ধর্মীয়-সামাজিক নাটক নয়, বরং তাঁর বাবার রেখে যাওয়া এক ঐতিহ্য, যার ভবিষ্যৎ সফলতার দায়ভার বর্তমানে মাজিদবাবুর কাঁধে। ১৯৬৩ সালে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করতে ও সৌভ্রাত্রিত্ব বজায় রাখতেই মাজিদবাবুর বাবার এমন প্রয়াস। মঞ্চের পর্দা সরে গেলে দেখা যায়, একদল আত্মমগ্ন অভিনেতাকে। গণেশ পূজন, রাম বিবাহ, সেতু বন্ধন-এর মতো রামায়ণের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অংশেই সযত্নে আলোকপাত করেন তাঁরা। অনুষ্ঠান শেষ হয় শ্রী রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক দেখিয়ে। এরপর অর্কেস্ট্রা সমেত তাঁরা ঘুরে বেড়ান গ্রামের পথে পথে, আর এই সময়েই গ্রামের কমবেশি সকলেই নাচ-গান নিয়ে সামিল হয়ে যায় সেই আনন্দ-মিছিলে। রামলীলা হয়ে অঠে সবার, শ্রী রামচন্দ্র তাঁর মনুষ্যোচিত আনন্দ-বেদনা সমেত পৌঁছে যান প্রত্যেক দর্শকের হৃদয়ে।