নদী, বন গড়ে ওঠে প্রকৃতির খেয়ালে। অথচ মানুষ নিজের স্বার্থে সেসব ধ্বংস করে। তবে সবাই এক নন। ধ্বংসের বদলে সৃষ্টিও ভালোবাসা অনেকের। ঠিক যেমন এক ব্যক্তি নিজে হাতেই গড়েছেন আস্ত একটা বন। কার কথা বলছি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
উঁচু ইমারত তৈরি হবে। কিংবা চওড়া হবে রাস্তা। তার জন্য গাছ কাটতে হোক, আপত্তি নেই। গাছদের হয়ে কেই বা প্রতিবাদ জানাবে! প্রকৃতি অবশ্য নিজের মতো করে প্রতিশোধ নেয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি থেকে ভয়ঙ্কর ঝড় সবই সহ্য করতে হয়। ক্ষতিও হয় যথেষ্টই। তাও প্রকৃতি ধ্বংসের খেলা কার্যত বন্ধ হয় না।
আরও শুনুন: ধর্মের নামে কাটা পড়বে লক্ষ গাছ! তাপে পুড়লেও যোগীরাজ্য বোঝাল, পরিবেশ ফেলনাই
বিলুপ্ত হয় একের পর এক বন্য প্রাণী। হারিয়ে যায় একের পর এক গাছ। মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন তাঁরা সংখ্যায় আর কতজন! সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েও লাভ হয় না সেইভাবে। তাই প্রতিবাদের পথেই হাঁটেননি যাদব পায়েং। অসমের একেবারে সাধারণ এক মানুষ। যিনি স্রেফ ভালোবেসে গড়েছেন আস্ত একটা বন। নিজে হাতে, তৈরি করছেন সবটা। তাও অল্প জায়গায় নয়, প্রায় ১৩৬০ একর জুড়ে বন তৈরি করেছেন তিনি। একদিনে হয়নি অবশ্যই। জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন এই বন তৈরিতে। শুরুটা আশির দশকে। তখন পায়েং ও তাঁর গ্রামের মানুষজন ব্রহ্মপুত্রের পার্শ্ববর্তী এক দ্বীপে থাকতেন। ভূমিক্ষয়ের কারণে সেই জায়গা ছেড়ে তাঁরা চলে যান অন্যত্র। এইসময় যাদবের বয়স খুব বেশি হলে ১০। মাঝেমধ্যেই নিজেদের পুরনো জায়গা দেখে আসতেন যাদব। এর মাঝে একবার ভয়ঙ্কর বন্যা হয়। তাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় অসমের বিস্তীর্ণ এলাকা। বাদ যায়নি ওই দ্বীপও। প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় ওই দ্বীপ। কয়েকহাজার প্রাণী মারা যায় সেই বন্যায়। এই অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন যাদব। গ্রামে ফিরে সকলের কাছে অনুরোধ করেব, দ্বীপের অবস্থা আগের মতো করা হোক। কিন্তু সেই সময় তাঁর কথায় তেমন আমল দেননি কেউ। বরং পরিবেশ নিয়ে না ভেবে যাদবকে নিজের কথা ভাবতে বলেন সকলে। এর মাঝে এই বৃদ্ধ কিশোর যাদবের হাতে তুলে দেন বেশ কিছু গাছের চারা, এবং বীজ।
আরও শুনুন: অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে! শুধু টাকা নয়, নির্বাচনী আশ্বাসে জুড়ছে পরিবেশের ভাবনাও
সেই শুরু। একাই দ্বীপে গিয়ে গাছের চারা বসান যাদব। ছড়িয়ে দেন বীজ। এরপর আরও অনেকের কাছ থেকে বীজ আর চারা সংগ্রহ করে দ্বীপে ছড়িয়ে আসেন যাদব। বছরের পর বছর সেই গাছের পরিচর্যা করেন যাদব। প্রকৃতিও তাঁর এই পরিশ্রমের কদর দেয়। ধীরে ধীরে তাঁর ছড়িয়ে দেওয়া বীজ থেকে চারা জন্মায়, সেসব বড় হয়। একসময় গোটা এলাকা ভরে ওঠে নতুন গাছে। হারিয়ে যাওয়া জঙ্গল নতুন করে তৈরি হতে থাকে। বন্যায় যে হাজার হাজার প্রাণীর মৃত্যু হয়েছিল ধীরে ধীরে ফিরে আসে তারাও। মূলত পাখি আর সাপের আস্তানা ছিল এই দ্বীপ। তার রকমফের অবাক করে সকলকে। দেশের অন্যান্য প্রান্তে খুঁজে পাওয়া কঠিন এমন সাপও যাদবের তৈরি এই বনে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতি দেয় দেশের সরকারও। জেএনইউ-র তরফে যাদবকে ‘Forest Man of India’ শিরোপা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয় যাদবকে। স্রেফ দেশ নয়, বিদেশের মাটিতেও সম্মানিত হয়েছে যাদব। যেখানে নিজেদের স্বার্থে প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসের খেলায় মাতেন অনেকে, সেখানে যাদবের এই কাজ নিঃশব্দ প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে আজও।