মহিলা নয়, বিদায়বেলায় মাকে বরণ করেন পুরুষরা। এমনটাই শতাব্দীপ্রাচীন নিয়ম। নিষ্ঠাভরে বরণের যাবতীয় আচার পালন করেন এলাকার পুরুষরা। তার জন্য শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর, পরতেও আপত্তি থাকে না কারও। কোন পুজোর কথা বলছি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
মাথা উঁচু করে দেখুন! চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো সম্পর্কে এমনটাই বলে থাকেন সকলে। কারণ একটাই, বিশালাকায় মূর্তি। তাতে থিমের বালাই নেই বললেই চলে। চিরন্তন সনাতনী মাতৃপ্রতিমাই বছরের পর বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছে। তবে স্রেফ চন্দননগর নয়, পুজো হয় ভদ্রেশ্বর, মানকুন্ডু সহ পাশ্বর্বর্তী সমস্ত এলাকাতেই। সেখানেই রয়েছে এই অঞ্চলের সবথেকে পুরনো জগদ্ধাত্রী। ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলার বুড়ি মা।
জগদ্ধাত্রী পুজো বললেই চন্দননগরের কথা মনে আসে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। প্রতি বছর জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে বিশেষভাবে সেজে ওঠে আলোর শহর। বাহারি আলোয় শহরের চারিদিক ভরে ওঠে। প্রাচীনত্বের সঙ্গে নতুন ছোঁয়া ধরা পড়ে শহরের ইতিউতি। প্রাচীন বলতে অবশ্য পুজোর কথাই বলছি। শহরের একাধিক পুজোর বয়স ১০০ ছুঁই ছুঁই। তবে সবথেকে পুরনো পুজোর তালিকায় রয়েছে ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলার জগদ্ধাত্রী। চলতি বছরে এই পুজো ২৩২ বছরে পড়ল। স্থানীয়দের কাছে তো বটেই, গোটা বাংলায় এই পুজো প্রসিদ্ধ। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন পুজো দিতে। নিয়ম মেনে নিষ্ঠা ভরে পুজো হয়। বিশাল মূর্তিতে পরানো হয় কয়েকশো বেনারসী শাড়ি। থিমের বালাই নেই। পুজোই এখানে মুখ্য। পাশাপাশি এখানকার বরণের নিয়মটিও বেশ অন্যরকম। সাধারণত বিদায়বেলায় মাকে বরণের দায়িত্ব থাকে মহিলাদের। বিশেষ করে বিবাহিত মহিলারাই নিয়ম মেনে মায়ের বরণ করেন। মায়ের মূর্তিতে ছোঁয়ানো সিঁদুর এঁকে অন্যের সিঁথিতে রাঙিয়ে দেন। এখানেও সেই নিয়মেই মায়ের বরন হয়। তবে মহিলারা নন, মা-এর বরণ করেন পুরুষরা।
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। শতাব্দী প্রাচীন পুজোয় এমনটাই নিয়ম। দশমীর দিন ভদ্রেশ্বরের ওই পুজোমণ্ডপে গেলে এমনই ছবি দেখা যাবে। এলাকার পুরুষরা মহিলা সেজে বরণ করছেন। কারও এই প্রথমবার। কারও আবার বছর পাঁচেকের অভিজ্ঞতা। পরনে শাড়ি, মাথার উপর ঘোমটা, কপালে লম্বা সিঁদুরের ফোঁটা। কেউ গোঁফের মায়া ছাড়তে পারেননি। একটা দিনের জন্য সাধের ফ্রেঞ্চ কাটও উড়িয়ে দেননি কেউ কেউ। সেই অবস্থাতেই হাতে ধরা বরণডালা। কারও হাতের ঘটিতে আবার গঙ্গাজল। নিয়ম মেনে এয়ো স্ত্রী-দের মতোই প্রতিমা প্রদক্ষিণ করে বরণ করেন সকলে। তবে এর নেপথ্যে বিশেষ কাহিনিও রয়েছে।
চন্দনগরের মতো কৃষ্ণনগরেও জগদ্ধাত্রীপুজোয় বেশ ধুম চোখে পড়ে। বলা হয়, সেখানেই প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো শুরু করেন। তাঁর কোনও এক দেওয়ানের হাত ধরেই এই পুজো চন্দনগরে আসে। নতুন করে শুরু হয় দেবী বন্দনা। এই মতের আরও অনেক ব্যাখ্যা থাকলেও, মোটের উপর এমনটাই অনেকে বিশ্বাস করেন। আর সেই হিসাবে ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলার মাকেই প্রাচীনতম মনে করেন কেউ কেউ। সময়ের হিসাবে দেখলে এই পুজোর শুরুটা একেবারে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে। এর থেকেই পুরুষদের বরণ করার ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে। আসলে, ব্রিটিশ পর পুরুষের সামনে বাড়ির মহিলাদের যাওয়ার অধিকার ছিল না। তাই বারোয়ারী পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতেন পুরুষরাই। এমনকি মায়ের বরনও ছেলে সেজেই করতেন তাঁরা। তেঁতুলতলার পুজোয় এই রীতি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সেকালে। যা এতটুকু বদল হয়নি এজাকের দিনেও। মহিলারা থাকলেও মায়ের বরণ করেন সেই পুরুষরাই। তা দেখতে আসেন বাইরের সকলে।