যারা পাহাড় চড়তে ভালোবাসে, যাদের কাছে বিষয়টা নেশার মতো, তারা প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখে এভারেস্ট আরোহণের। একবার ভাবলেই এই অভিযান করা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হয়। যার প্রথম ধাপটা অবশ্যই এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছানো। সদ্য সেই অভিযান সম্পূর্ণ করে ফিরেছেন সাত্যকি চট্টোপাধ্যায়। যাত্রাপথের নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে ইয়েতি দর্শনের কথা ভাগ করে নিলেন। লিখলেন শুভদীপ রায়।
‘এভারেস্ট’ শুনে কেমন যেন চমকে উঠলেন। বোধহয় বহুদিন পর নামটা শুনলেন। খানিক বিরক্তও হলেন। মাথায় হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন একটা বললেন। ঠিক বোঝা গেল না। একজন নয়, এমনটা করলেন আরও অনেকে। অবাক হওয়ার মতোই কাণ্ড। কারণ যে গ্রামকে ‘গেটওয়ে অফ এভারেস্ট’ বলা হয়, সেখানকার মানুষ এমন আচরণ করছেন! তবে অবাক হওয়ার যে আরও অনেক বাকি, তা বোঝা গেল খানিক পর।
এপ্রিলের মাঝামাঝি একটা সময়। কলকাতায় তখন ভরা গরম। ঘাম মুছতে মুছতে হাওড়া থেকে ট্রেনে ওঠা। সঙ্গী মা আর ছোটবেলার এক বন্ধু। গন্তব্য ‘এভারেস্ট বেসক্যাম্প’। ব্যাপারটা শুনতে যত রোমাঞ্চের মনে হচ্ছে, আদতে নয়। তার চেয়েও খানিক বেশি। সঙ্গে মিশে আছে ভয়, অবাক হওয়া, আরও অনেককিছু। ব্যাপারটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। তবে যাত্রা পথে এমন অনেক কিছুর সাক্ষী থাকতে হয়েছে, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়েছে স্বপ্ন নয়, ঘোর বাস্তব। ইয়েতি দর্শন এমনই এক অধ্যায় বলা যায়।
অনেকেরই ইয়েতির সঙ্গে পরিচয় কাকাবাবুর হাত ধরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পড়ে ইয়েতি সম্পর্কে একরকম ধারণা হয়েছিল বটে। পরে সিনেমায় দেখানো ইয়েতিও বেশ রোমাঞ্চ দিয়েছে। তবে পাহাড়ের মানুষজন ইয়েতিকে খানিক অন্যভাবে চেনেন, সেটা বুঝলাম এই প্রথমবার। এতদিন ভাবতাম বিষয়টা কাল্পনিক। বেসক্যাম্প যাত্রা শুরুর আগেও এমনটাই বিশ্বাস ছিল। তবে এখনও যে একইভাবে ইয়েতির অস্তিত্ব নিয়ে চরম অবিশ্বাস রয়েছে, এটা বলতে পারব না। তার কারণ স্বয়ং ইয়েতি!
নাহ না, পথের মাঝে ইয়েতির থাবা দেখিনি। কিংবা দৈত্যাকার সাদা চেহারার কেউ পথ আটকে দাঁড়ায়নি। বরং যা দেখেছি তা গল্পের বর্ণনার চাইতে অনেকটা আলাদা। বাদামী কালো রঙের একটা খুলি। মানুষের খুলির মতো চোখ-নাক-মুখ আলাদা করে বোঝা যায় না। অনেকটা পরচুলা মনে হবে দূর থেকে। কিন্তু জিনিসটা এতটাই বড়, দৈত্য ছাড়া কারও পরা সম্ভব নয়। রাখা আছে কাচের বাক্সে। চারপাশে বিভিন্ন অঙ্কের নোট, খুচরো কয়েন পড়ে আছে। সবাই আসছেন, বাক্সে থাকা খুলির উদ্দেশে প্রণাম জানাচ্ছেন, আবার ফিরে যাচ্ছেন। বাক্সের পাশে থাকা বোর্ডে লেখা, ‘দ্য ইয়েতি স্কাল’! এখান থেকে গল্পের শুরু। ইয়েতি সম্পর্কে ধারণা বদলের প্রাথমিক পাঠও এই খুলির দর্শন। তবে স্রেফ লেখা আছে বলেই যে বিশ্বাস করে নিতে হবে ওটা ইয়েতির খুলি, এমনটা মনে হয়নি। ধারণা বদলেছে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে। কোথায় দেখলাম এই ইয়েতির খুলি? সেই প্রসঙ্গেই ফেরা যাক।
ইতিমধ্যেই কাঠমান্ডু, সালেরি, সুরকে সহ আরও অনেক জায়গা পেরিয়েছি। পাহাড়ি জায়গা। তার সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রতিটা জায়গাই যেন আগেরটার তুলনায় অন্যরকম। আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে প্রত্যেকটার। তবে ইয়েতির খুলি যেখানে দেখেছি, সেই জায়গা আলাদা প্রশংসার দাবি রাখে বইকি। তার অন্যতম কারণ এখন থেকেই প্রথমবার দেখলাম এভারেস্ট। কথা বলছি, নামচে বাজার সম্পর্কে। অনেকের কাছেই যা ‘গেটওয়ে অফ এভারেস্ট’ হিসেবে পরিচিত। নেপালের সোলোকুম্ভু রিজিওনের এই শহরের উচ্চতা প্রায় ৩৪৪০ মিটার। কিন্তু সেখানে পা রাখলে এই উচ্চতা ঠাহর করা কঠিন। চারপাশে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে সমতলের কোনও আধুনিক শহরে রয়েছি। কি নেই সেখানে! ঝাঁ চকচকে হোটেল থেকে সুন্দর রাস্তাঘাট, দোকানপাট সব আছে। অবশ্য উচ্চতা টের পাওয়া যায় ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট দেখে। এখানে আসার পথে হিলারি ব্রিজ পেরোতে গিয়ে ভালোমত টের পেয়েছিলাম ব্যাপারটা। সেদিনটা নামচে বাজারেই থাকা। বিষয়টাকে acclematization বলে। অর্থাৎ এতটা উচ্চতায় একদিন থেকে সেই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। এখানেই রয়েছে ‘এভারেস্ট ভিউ হোটেল’।
সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পর্বতসুন্দরীকে। স্বচক্ষে দেখলাম। অবাক হলাম। ছবি তুলে মনে মনে ভাবলাম আরও একটা স্বপ্নের কথা। যেহেতু এখানেই একটা দিন থাকা তাই চারপাশটা ঘুরে দেখতেই হতো। স্থানীয়দের কথা শুনে পা বাড়ালাম কুমঝুঙের দিকে। শুনলাম এই গ্রাম নাকি অপূর্ব সুন্দর। যেহেতু সময় আছে তাই এগিয়ে চললাম সেই দিকে। ঘণ্টা তিনেক সময় লাগল। পুরোটাই পায়ে হাঁটা। তবে পৌঁছে যা দেখলাম তাতে সব কষ্ট উবে গেল। যাত্রা পথটাও বড় সুন্দর। জঙ্গলের মাঝ বরাবর রাস্তা। একপাশে থামসেরকু পর্বত। এসবের গল্প এতদিন শুধু শুনেছি, এবার সামনে থেকে দেখার পালা। রাস্তা থেকেই দেখা পেয়েছিলাম ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, কুমঝুঙের। কাছে যাওয়ার খিদেটা তখনই যেন বেড়েছিল আরও। যথাসময় পৌঁছলাম। যেন রূপকথার রাজ্য! কী সুন্দর সাজানো-গোছানো চারদিক। সবটাই তাকিয়ে দেখার মতো। তবে স্থানীয়রা জানাল, এখানে প্রধান দর্শনীয় স্থান এক মনেস্ট্রি। সাধারণত এইসব গ্রামে একটা করে মনেস্ট্রি থাকা স্বাভাবিক। তবে এই মনেস্ট্রির নাম আলাদাভাবে বলার কারণ রয়েছে। আর সেই কারণটাই হল ইয়েতি!
ঠিক ধরেছেন, কাচের বাক্সে রাখা যে খুলির কথা বলছিলাম, সেটি এই মনেস্ট্রিতেই রাখা আছে। ভয় নয়, স্থানীয়দের কাছে এই ইয়েতির খুলি অত্যন্ত শ্রদ্ধার জিনিস। তাই সবাই মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছেন। দক্ষিণাও দিচ্ছেন কেউ কেউ। ভিড় ছিল না তেমন। পাশে রাখা বোর্ডে বিস্তারে লেখা রয়েছে ইয়েতি খুলির ইতিহাস। জানলাম, স্যর এডমুন্ড হিলারি নানা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছেন এটি নকল জিনিস নয়। অর্থাৎ সত্যিকারের ইয়েতির খুলি। তাও ৩০০ বছরের পুরনো। এতদিন ধরে যা সযত্নে রাখা আছে কুমঝুঙ গ্রামের ওই মনেস্ট্রিতে। তবে সামনে থেকে এইসব দেখা মানেই যে বিশ্বাস করে নেওয়া তা নয়। সেটার জন্য আরও কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে হয়।
প্রথমেই বলেছি এই অঞ্চলের লোকজন এভারেস্টের নাম শুনলেই খানিক অবাক হচ্ছিল। কারনটা প্রথমে না বুঝলেও ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি। আসলে, এভারেস্ট এদের কাছে স্রেফ পর্বতশৃঙ্গ নয়, ভগবানের সমতুল্য। স্থানীয় ভাষায় তাই এভারেস্ট হল ‘সাগরমাথা’। এই নাম এখানে বেশ প্রচলিত। বলা ভালো, এই নামেই সবাই চেনে এভারেস্টকে। আসলে, এই গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই শেরপা। কাজেই এভারেস্টের উপর এদের রুটি-রুজি অনেকটা নির্ভর করে। তাই শুধুমাত্র এডভেঞ্চারের জন্য এভারেস্টকে কল্পনা করতে পারেন না এরা। ইয়েতির ভাবনাটাও খানিকটা তেমন। সমতলের মানুষের কাছে যা কল্পনা, এরা সেটাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করেন। কেউ কেউ দাবি করেন, সামনে থেকে দেখেছেন। তবে সিনেমার মতো বীভৎস দানব নয় সে ইয়েতি। বরং তার দর্শন যে কোনও বাধা কাটিয়ে দিতে পারে।
এই কথাগুলো মনে বেশ দাগ কেটেছিল। যে ভয়ঙ্কর যাত্রার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম, তাতে মনে মনে আরাধ্যের শরণ নিয়েছি বহুবার। সেই তালিকায় ইয়েতির মতো কাউকে জুড়লে যদি ভালো হয়, তাহলে ক্ষতি কি! এই ভাবনা মনে আসতেই অবিশ্বাসের পাথর খানিক টলেছিল। পথে দেখেছি, ইয়েতির নামে হোটেল। যদি সত্যিই ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর কিছু হয়ে থাকে এই ইয়েতি, তাহলে তার নামে হোটেলের নাম কেন রাখবেন কেউ? এই ভাবনাও ইয়েতি সম্পর্কে ধারণাটা খানিক বদলে দিল। আলাদা করে নামচে বাজার বা কুমঝুঙের স্থানীয়দের মতো ইয়েতির নাম করে মাথা হাত দিইনি। তবে ওই মনেস্ট্রিতে রাখা খুলির সামনে মনের অজান্তেই প্রণাম ঠুকেছি। তাতে আর যাই হোক, ক্ষতি তো কিছু হয়নি! তাই সমতলে ফিরে এসে ইয়েতি নিয়ে সিনেমায় দেখা সেই দানবের ভাবনা যে অনেকটাই বদলেছে তা বলা যায়।