যুদ্ধের সময়ে নিজের দেশেও কি ভালো থাকতে পারে মেয়েরা? অন্য কেউ শরীর কেড়ে না নিলেও সেখানে শরীরকে পণ্য করতে হয় বইকি, কেন-না শরীর বিকিয়েই যে খাবার মেলে যুদ্ধের দেশে।
যুদ্ধ সবকিছুই নিয়ে যায়। নারীকেও। ক্ষমতায় ক্ষমতায় যে যুদ্ধ বাধে, তাতে ধ্বংস হয়, লুঠ হয়, আর সেই লুঠের মাল হিসেবে বিলিয়ে যায় নারীশরীর। সে লুণ্ঠন তো কেবল একরকমভাবে হয় না। শত্রুসেনার হাতে প্রত্যক্ষভাবে লুঠ হয়ে যাওয়ার ইতিহাস তো রয়েছেই। কিন্তু তা ছাড়াও, যুদ্ধের সময়ে নিজের দেশেও কি ভালো থাকতে পারে মেয়েরা? অন্য কেউ শরীর কেড়ে না নিলেও সেখানে শরীরকে পণ্য করতে হয় বইকি, কেন-না শরীর বিকিয়েই যে খাবার মেলে যুদ্ধের দেশে। আর সেই নির্মম সত্যকেই এখন জীবন দিয়ে বুঝছেন মায়ানমারের মেয়েরা। জানা যাচ্ছে, ডাক্তার কিংবা নার্সের পেশায় যাওয়ার কথা ছিল যাদের, তার জন্য দীর্ঘ পড়াশোনা আর পরিশ্রমের পথ পেরিয়ে এসেছেন, যুদ্ধের পরিস্থিতি তাঁদের বাধ্য করছে সেই স্বপ্নের কাজ ছেড়ে দেহব্যবসাকেই পেশা হিসাবে বেছে নিতে। কেন-না, অন্য কোনও পেশায় যে খাবার জুটছে না। স্রেফ নিত্যদিনের খাবারটুকু জোটাতেই দলে দলে দেহব্যবসায় যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন সে দেশের মেয়েরা, জানাচ্ছে সংবাদসংস্থা।
২০১৭ সালে মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী আউং সান সু চির দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’র নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করেছিল মায়ানমার সেনা। শুরু হয়েছিল সামরিক জুন্টার শাসন। আবার এই সময়ে বিদ্রোহী জোটের ধারাবাহিক অগ্রগতিতে বেসামাল মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকার। সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে পড়শি তাইল্যান্ড এবং চিনের সীমান্তবর্তী এলাকার বড় অংশ আগেই নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল বিদ্রোহী জোট। এবার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অধিকাংশ এলাকাই বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখল করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে দেশের অর্থনীতিও টালমাটাল। বাসিন্দারা বলছেন, সামান্য ডিম বা টুথপেস্টের দামও তিনগুণ হয়ে গিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ-এর মতে, দিনের একবারের খাবারের দাম ১৬০ পারসেন্ট বেড়ে গিয়েছে। আর এই অবস্থায় রোজকার খাবারটুকু জোটাতেই নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। অন্য উপায় না পেয়ে আদিম ব্যবসার দিকেই ঝুঁকছেন বহু মেয়ে।
যেমন এক তরুণীর কথা জানা যাচ্ছে, যিনি মায়ানমারের মেডিক্যাল স্কুলে ৭ বছর পড়াশোনা করেছেন। ডাক্তারি ডিগ্রি পাওয়ার পর চাকরিও পান। কিন্তু মাসখানেক চাকরি করার পরই দেখেন, ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরের সঙ্গে মাইনের টাকা পাল্লা দিতে পারছে না। এর মধ্যেই তাঁর বাবার কিডনির অসুখ ধরা পড়ে। এহেন নিরুপায় পরিস্থিতিতে তিনি দেখা পান ‘ডেট গার্ল’-দের। দেখা যায়, ওই নারীরা তাঁর প্রায় দ্বিগুণ টাকা উপার্জন করেন। ওই তরুণীর কথায়, এত বছরের ডাক্তার হওয়ার পড়াশোনা পেরিয়ে এসে শেষে দেহব্যবসার মাধ্যমে জীবনধারণ করতে হবে, এ কথা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু উপায় ছিল না। পরিবার জানে না, তবে আপাতত প্রায় বছরখানেক ধরেই মায়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে গণিকার পেশা যাপন করছেন বছর ২৬-এর তরুণী। আবার মান্দালয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে নার্স হিসাবে কাজ করতেন যে তরুণী, তিনি জানাচ্ছেন, চিকিৎসাকর্মীরা প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন বলে সে হাসপাতাল বন্ধ করে দেয় সেনা সরকার। স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যই এই পেশায় এসেছেন বছর পঁচিশের তরুণী।
যদিও মায়ানমারে দেহব্যবসা বেআইনি, কিন্তু জানা যাচ্ছে, লুকিয়েচুরিয়ে সে ব্যবসা চলে ভালোমতোই। আর দেশের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সেই ব্যবসায় এক নয়া বাহিনী যোগ করেছে। ডাক্তার, নার্স, শিক্ষিকা, এমন নানা পেশার নারীরাই বাধ্য হচ্ছেন এই পেশায় আসতে। কেননা অন্য পেশার উপার্জনে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে নাম গোপন করে কথা বলেছেন এমনই অন্তত ছ-জন মহিলা। যাঁদের মধ্যে চারজন তথাকথিত ভদ্রবিত্তের শিক্ষিত পেশায় ছিলেন, দুজন ছিলেন মানবাধিকার কর্মী। যদিও যুদ্ধের দুনিয়ায় খর্ব হয়ে গিয়েছে তাঁদের নিজেদের অধিকারই। সে যুদ্ধে তাঁদের হাত ছিল না যদিও। কিন্তু নিজের শর্তে, নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সে অধিকার আদৌ কোনও দিন ফিরবে কি না, জানেন না মায়ানমারের মেয়েরা।