আচ্ছা ‘দুর্গা’ নামটা শুনলেই, চোখের সামনে ঠিক কী ভেসে ওঠে? দশভুজা দেবী, মহিষাসুরমর্দিনী, মাতৃস্বরূপা চণ্ডীকা। এ ধারণায় কোনও ভুল নেই। তবে দুর্গা মানে শুধুই যে ওই একটি মাত্র রূপ তা নয়। শাস্ত্রীয় বাখ্যায় তিনি যেমন ধরা দিয়েছেন ভিন্নমাত্রায়। লৌকবিশ্বাসেও ধরা পড়েছে দুর্গার নানা রূপ। দেবীর সেইসব রূপের কথাই শুনে নেওয়া যাক। আজ রইল ‘বনবিবি’-র বর্ণনা।
সুন্দরবন। শহুরে মানুষের উইকেন্ড ডেস্টিনেশন। গভীর বনে সাফারি, খাঁড়ির মধ্যে কুমীরের ছবি তুলতে তুলতে নৌকাবিহার, সেইসঙ্গে জমিয়ে ইলিশ-মাংস। কিন্তু এসব ছাড়াও সুন্দরবন বলতে আর যা কিছু বোঝায়, তার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন বনবিবি। একথায় বলতে গেলে, তিনিই হলেন ‘সোঁদরবনের দুগগা’।
শুধু বাংলা নয়। কাঁটাতারের বেড়া টপকে বাংলাদেশের বেশ কিছুটা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক নিমর্ম সুন্দর অরণ্য। বলা ভালো, পৃথিবীর অন্যতম গভীর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। ‘জলে কুমীর ডাঙ্গায় বাঘ’ প্রবাদটার বাস্তব রূপ দেখা মেলে এখানেই। তবে সেখানকার মানুষদের কাছে এই বাঘ বা কুমীর স্রেফ হিংস্র প্রাণী নয়। বরং তার থেকে অনেকটা বেশি। সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, মানুষ যখন যা ভয় পেয়েছে তখন তাকেই দেবতা জ্ঞানে পুজো শুরু করেছে। একসময় আগুন, মাটি, পাহাড়, নদী, সমুদ্র সবকিছুর পুজো করার চল ছিল। পরে অবশ্য এর থেকেই অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্র-এঁদের আবির্ভাব। সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই ছবিই ধরা পড়ে। সেখানকার মানুষের ত্রাস, রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পেটের দায়ে জঙ্গলের একটু গভীরে ঢুকে পড়লেই সর্বনাশ। কখন যে ঘাড়ে কামড় বসাবেন তিনি তা আগে থেকে বোঝা কঠিন। তাই স্থানীয়দের কাছে পরম পূজনীয় ব্যাঘ্র দেবতা দক্ষিণ রায়। ভাবছেন তো, এসবের মধ্যে বনবিবি এলেন কোথা থেকে?
ঠিক যেভাবে মহিষাসুর বধ করতে দেবী দশভুজা দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিল। ঠিক সেভাবেই সুন্দরবনের মানুষের রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে রয়েছে বনবিবি। নাম থেকেই এটুকু স্পষ্ট, এই দেবীর আরাধনা কোনও নির্দিষ্ট এক ধর্মের মানুষ করেন না। হিন্দু -মুসলিম সবার কাছেই তিনি আরাধ্যা। মূর্তিতে আর পুজোর নিয়মে কিছুটা বদল অবশ্যই রয়েছে। তবে দেবীর কাছে প্রার্থণা সকলেরই কিছুটা একইরকম। তাঁরা সকলেই দেবীর সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বলেন,
“মা বনবিবি, তোমার বাল্লক এল বনে,
থাকে যেন মনে।
শত্রু দুষমন চাপা দিয়ে রাখ গোড়ের কোণে।।”
অর্থাৎ পেটের দায়ে বনের গভীরে প্রবেশ করলেও বনবিবি যেন সর্বদা সহায় থাকেন। সেইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, এখানে বাল্লক অর্থে যার কথা বলা হয়েছে তিনি যে কোনও বয়সের হতে পারেন। পঞ্চাশ-ষাট কিংবা তার থেকেও বেশি। আচ্ছা আবার তাহলে দেবী মূর্তিটা ঠিক কেমন সে কথা বলি। দেবীর বাহন অতিকায় একটি বাঘ কিংবা একটি মুরগি। এক হাতে ত্রিশূল আর অন্য হাতে মুগুর। কোথাও তাঁর পরনে শাড়ি। কোথাও আবার তিনি খানদানি মুসলমান ঘরের কিশোরী বালিকা। পরনে পিরান বা ঘাঘরা পাজামা, পায়ে জুতো, গলায় বন-ফুলের মালা আর সঙ্গে পাতলা ওড়না। মূর্তি সাধারণত মাটির। সারাবছর যে পুজো হয় এমন নয়। নির্দিষ্ট দিনে বার্ষিক উৎসব হলে মূর্তিটি রং করা হয়। কয়েকবছর একই মূর্তিতে পুজো হচ্ছে এমনটাও দেখা যায়। তাই বলে বনবিবির একেবারেই যে মন্দির নেই তা নয়। কিছু জায়গায় দেবীর রীতিমতো সুন্দর মন্দির চোখে পড়ে। সেখানে তাঁর সঙ্গেই থাকে ব্রাঘ্য দেবতা দক্ষিণ রায়ের মূর্তি। এমনকি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামেও দেবী মূর্তির পাশে বাঘ এবং দক্ষিণ রায়কে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে অবশ্য বেশ কিছু লোককাহিনী রয়েছে। শোনা যায়, কোনও এক কালে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধে করতে গিয়ে গো হারা হারেন বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়। সেই থেকেই তিনি দেবীর আদেশ মেনে চলতে বাধ্য। আবার সুন্দরবনের সব বাঘ দক্ষিণ রায়ের নির্দেশে চলে, এমনটাই স্থানীয় বিশ্বাস। তাই বনবিবির পুজো করলে বাঘের ভয় যে থাকবে না একথা বলাই বাহুল্য। তবু তিনি লৌকিক দেবী। ঠিক যেভাবে সর্পদেবী মনসা, কালের নিয়মে ঐশ্বর্য্য, ধন সবকিছুর দেবী হিসেবে পূজিতা হন কোথাও কোথাও। তেমনই বনবিবির পুজোও যে স্রেফ বাঘের হাত থেকে বাঁচতে করা হয় এমনটা হয়। বরং সুন্দরবনের মানুষের কাছে তিনি দুর্গা রূপেই ধরা দেন। সারাবছর যেন সুখে শান্তি কাটে সেই প্রার্থণা নিয়েই এখনও দেবীর পুজো করেন সেখানকার মানুষজন।