রাজস্থানের ধু-ধু মরুভূমি। তার মাঝখানে যেন একচিলতে মরূদ্যান। গলা ভিজবে না, তবে মন ভিজতে বাধ্য। কারণ এখানেই হদিশ মেলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন জনপদের। আর তার মধ্যেই রয়েছে এক বিরল মন্দির। বিরল, কারণ এই দেবীর মন্দির আর কোথাও দেখা যায় না। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই মন্দিরের কথা।
হিন্দু পুরাণ মতে, দেবতাদের রাজা ইন্দ্র। আর দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী শচী। পুরাণে শচীর প্রসঙ্গ এলেও তাঁকে আলাদা করে দেবীত্বে উন্নীত করা হয়নি। শচীর মন্দির আছে, এমন কথাও শোনা যায় না। কিন্তু এই ধারণা বদলে দেয় রাজস্থানের অশিয়াতে অবস্থিত সচিয়া মাতা মন্দির। কেবল ধর্মের কারণেই নয়, শিল্পসৌন্দর্যের দিক থেকেও এই মন্দিরটি অভিনব। অবশ্য এই মন্দিরের দেবী আসলে কে, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। প্রচলিত রয়েছে একাধিক কাহিনিও।
আরও শুনুন: শুধু মাথার চুল থেকেই আয় প্রায় ১২৬ কোটি টাকা! তিরুপতি মন্দিরের বার্ষিক আয় কত জানেন?
কারও কারও মতে, এই মন্দিরের উপাস্য দেবী সচিয়া মাতা আসলে দেবরাজ ইন্দ্রের ধর্মপত্নী শচী দেবী। স্থানীয়েরা এঁকে অশিয়া মাতাজিও বলেন। এই অঞ্চলের অধিবাসী অশওয়ালরা এই দেবীকে নিজেদের কুলদেবীর মর্যাদা দিয়ে থাকেন। শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিনটিকে নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন তাঁরা। আর সেই উৎসবে সামিল করে নেন দেবী সচিয়া মাতাকেও।
রাজস্থানে প্রচলিত কোনও কোনও গল্প আবার ভিন্ন কথা বলে। শচী দেবী নন, সচিয়া মাতা মন্দিরের মূল দেবী আসলে দেবী চামুণ্ডা, এমন মতেও বিশ্বাস করেন অনেকে। কিন্তু দেবী চামুণ্ডার নাম বদলে সচিয়া মাতা হল কেন? তাঁদের মতে, এককালে প্রতি বছর নবরাত্রিতে ধুমধাম করে পুজো হত দেবী চামুণ্ডার। দেবীর উদ্দেশে মোষবলি দেওয়া হত। কিন্তু এই বলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায় জৈন ধর্মগুরু রত্নপ্রভ সুরি আচার্যের নির্দেশে। জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন যাঁরা, তাঁদের মূল ব্রতই অহিংসা। একটি পিঁপড়েকেও হত্যা করেন না তাঁরা। আর সেই কারণেই এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই ধর্মগুরু। কিন্তু বলি বন্ধ করায় ভীষণ চটে যান দেবী। তাঁর অভিশাপে অন্ধ হয়ে যান আচার্য। কিন্তু এত বড় ক্ষতির পরেও যে আচার্য বিচলিত হলেন না। নিরুপায় দেবী মেনে নেন আচার্যের কথা। দেবী বলি বন্ধ করতে সম্মত হওয়ার পর আচার্য তাঁকে সম্বোধন করেন ‘সচ্চি মাতা’ বলে। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরাও তো তাঁরই সন্তান। পুজোর জন্য তাদের কারও প্রাণহানি করবেন না দেবী, এই বার্তা দিয়ে তিনি সত্যিই সকলের মা হয়ে উঠলেন। এমন ভাবনা থেকেই ‘সচ্চি মাতা’ নামটি এসেছিল।
আরও শুনুন: কেবল দেবতাই নন, সমন্বয়ের বার্তা দিয়ে দেশের এই মন্দিরে পূজিতা হন রাক্ষসীও
মন্দির কার, তার মীমাংসা হয়নি। কিন্তু থর মরুভূমির মধ্যে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন মন্দির। অষ্টম শতাব্দীতে যে অশিয়া বা উপকেশপুর ছিল জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র, এমনকি মেবার রাজত্বের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলির মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ, সেই সমৃদ্ধ নগরীতেই গড়ে উঠছিল মন্দিরটি। বারোশো শতাব্দীর শেষের দিকে মহম্মদ ঘোরির আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এই জনপদ। আজ তা মরুভূমিতে চাপা পড়া এক ধ্বংসস্তূপ মাত্র। সেই প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কেবল রয়ে গিয়েছে আঠেরোটি মন্দির। যার মধ্যে অন্যতম সচিয়া মাতার মন্দিরও।