তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশকে উন্নয়নের নিরিখেই বিশ্বসভায় সেরা করে তোলার নিয়েছিলেন অঙ্গীকার। ‘এক দেশ এক আইন’ নিয়ে আজ যখন দেশ মগ্ন, তখন ফিরে শোনা যাক পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর উন্নয়নের দর্শন।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের দেশ ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার পর সেই দেশের শাসনভার নিয়ে প্রিয় দেশকে উন্নয়নের সুতোতেই বাঁধতে চেয়েছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্য, সেই ঐক্যের অর্থ তাঁর কাছে ছিল উন্নয়ন। আসলে ভারতবর্ষের মতো একটা দেশকে এক সূত্রে বাঁধতে হলে যে, কোনও একটি নিরপেক্ষ সুতোরই দরকার, সে কথা বুঝেছিলেন তিনি। এমন এক সুতো, যা দেশের ভিতরকার ভিন্নতাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কোথাও সেই ভিন্নতার ভিত্তিতে তৈরি হবে না দ্বন্দ্ব। তিনি জানতেন, এই দেশে বিভিন্ন জাতি আর ধর্মের মানুষের বাস। সুতরাং তাঁদের জন্মসূত্রে পাওয়া কোনও পরিচয়কে ভিত্তি করে যদি তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করতে চান তিনি, সেক্ষেত্রে কোনও একটিমাত্র পরিচয় পাওয়া মুশকিল। প্রতিটি জাতি বা ধর্মের থেকে যে পৃথক স্বর সেখানে উঠে আসবে, তাতে দ্বন্দ্বের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তাই তিনি দেশের সব মানুষকে মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চাইলেন, তা উন্নয়ন। যে উন্নয়ন একইসঙ্গে দেশকে একতায় বাঁধবে, আবার বিশ্বমঞ্চে এই সদ্যস্বাধীন দেশকেও পায়ের তলায় মাটি দেবে।
আরও শুনুন: মন্দির গড়তে কেন টাকা দেবে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার? প্রশ্ন তুলেছিলেন নেহরু
এই যে অভিনব এক জাতীয়তাবোধ দেশবাসীর মধ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, তার মূলে ছিল সকলের জন্য সমান সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা। সে ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই। ভবিষ্যতের ভারতকে কেমন দেখতে চান তিনি? ১৯৫৩ সালে আগ্রার এক জনসভায় এ প্রশ্নের উত্তরে নেহরু তুলে ধরেছিলেন সেই জাতীয়তার ধারণা। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সব শিশু যেন জীবনে সফল হওয়ার সমান সুযোগ পায়, এই তাঁর লক্ষ্য। সবার জন্য সুযোগের সাম্য তৈরি করা, এই কথাটিকেই নিজের রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে রেখেছিলেন নেহরু। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের সেই বিখ্যাত ভাষণেও সুযোগের অসাম্য কমানোর কথা বলতে ভোলেননি তিনি।
সত্যি বলতে, দেশের স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি, তার শীর্ষে ছিলেন জওহরলাল। সেই সময়েই স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক বিলিবণ্টন প্রসঙ্গে নিজের ভাবনা স্পষ্ট করেছিলেন তিনি। সেখানেও প্রায় একই সুরে তিনি বলেছিলেন, কোনও মানুষের জীবনধারণ করতে যে প্রাথমিক সংস্থান লাগে, সেই চাহিদাগুলোর জোগান দিতে হবে রাষ্ট্রকেই। যাতে, মূল চাহিদাগুলো নিয়ে মানুষকে ব্যতিব্যস্ত হতে না হয়, বরং নিজের যাবতীয় মেধা ও শ্রম সে উন্নতির কাজে ব্যয় করতে পারে। সেই ব্যক্তিগত উন্নতি যে সদ্যস্বাধীন দেশকে সামগ্রিক উন্নয়নের পথে পৌঁছে দেবে, সে বিষয়ে সংশয় ছিল না পণ্ডিত নেহরুর। তাই, দেশের মোট উৎপাদনকে সকল দেশবাসীর মধ্যে ন্যায্যভাবে ভাগ করার কথাও বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন উৎপাদন বাড়ানোর কথা, না হলে যে বণ্টন করার জন্য দারিদ্র্য ছাড়া কিছুই পড়ে থাকবে না। অর্থাৎ বারে বারেই উন্নয়নের এক সূত্রে দেশের সমস্ত মানুষকে বেঁধে নিতে চেয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও সে গুরুত্বকে অস্বীকার করার জায়গা নেই।