রামায়ণ ও মহাভারত হিন্দুদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু সেই দুই গ্রন্থকেই ফারসি ভাষায় অনুবাদ করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন খোদ মুঘল সম্রাট আকবর। ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে, ভারতবর্ষের সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে যে দুইয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে, তা বুঝেছিলেন তিনি। আর দেশের প্রতিটি মানুষকেই সেই শিকড় চেনাতে চেয়েছিলেন সম্রাট। তাঁর সমন্বয়ের ভাবনা জারি ছিল এখানেও। শুনে নেওয়া যাক।
দেশের শিকড় চেনা জরুরি, আর সেই কারণেই জরুরি সে দেশের সংস্কৃতিকেও চিনে নেওয়া। ভারতবর্ষ শাসন করতে গিয়ে এই ভাবনাটি মনে রেখেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। আর তাই, এতদিন ধরে এ দেশে যে সাংস্কৃতিক পরম্পরা বয়ে চলেছে, মুসলিমদের কাছেও তা পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন বুঝেছিলেন তিনি। প্রাথমিকভাবে ভিনদেশ থেকে এলেও, মুসলিম শাসকেরা এ দেশেই পাকাপাকিভাবে বসত গড়েছিলেন। যে দেশে বসত, সেই দেশটিকে তো নিজের ভূমি বলেই চিনতে হবে। সে দেশ শাসন করতে গেলে চিনতে হবে দেশের মানুষের মনোভূমিকেও। সেই কারণেই হিন্দুদের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত ফারসিতে অনুবাদ করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন আকবর। ১৫৮০-র দশকে আকবরের শাসনকালে যে যে সাহিত্যের অনুবাদ হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ফারসি থেকে সংস্কৃতে অনূদিত হামজানামা আর সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনূদিত রজমনামা। এই রজমনামা-ই আসলে মহাভারতের অনুবাদ। রজম শব্দের অর্থ যুদ্ধ, নামা বলতে বৃত্তান্ত।
আরও শুনুন:
মুদ্রায় খোদাই রাম-সীতার ছবি, সমন্বয়ের বার্তা দিয়েছিলেন সম্রাট আকবর
ভারতবর্ষকে শাসন করতে গেলে ধর্মের ভেদ রাখা চলবে না, সম্মান করতে হবে সব ধর্মকেই। বাবর-এর এই কথা মনে রেখেছিলেন তাঁর পৌত্র আকবর। ভাষার বিভেদ পেরিয়ে হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বোঝার জন্যই অনুবাদকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। কেন বাদশা সংস্কৃত থেকে ফারসিতে মহাভারত অনুবাদ করছেন, তা বোঝাতেই আকবরের নির্দেশে রজমনামার প্রস্তাবনা লিখেছিলেন আবুল ফজল। ফতেপুর সিক্রিতে মক্তবখানা বানিয়ে সেখানেই চলত অনুবাদের কাজ। মূল বাল্মীকি রামায়ণ এবং বেদব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাভারত থেকেই অনুবাদ করা হয়েছিল। তবে অশ্বমেধ পর্বটি অনূদিত হয় জৈমিনি মহাভারত অবলম্বনে। আইন-ই আকবরী গ্রন্থে আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল অনুবাদকদের নাম, অনুবাদ শেষ হওয়ার তারিখ উল্লেখ করেছেন। যা জানাচ্ছে, বিদগ্ধ হিন্দু পণ্ডিত দেব মিশ্রের নির্দেশনায়, অনুবাদ করেছিলেন মোল্লা আব্দুল কাদির বদাউনি এবং নকিব খান। তবে এই বিশাল অনুবাদ প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন আরও অনেকেই। অনুবাদগ্রন্থে অলংকরণ চিত্রণও করেছিলেন দরবারের শিল্পীরা। ১৭৬টি ছবি আছে আকবরের রামায়ণে। বদাউনি জানিয়েছেন যে, আকবর এই সচিত্র গ্রন্থের অনুলিপি বিভিন্ন অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। বর্তমানে ফারসি ভাষায় অনূদিত ওই রামায়ণ ও মহাভারত রাখা আছে জয়পুরের সওয়াই মান সিং মিউজিয়ামে। যা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা তো বলেই, পাশাপাশি দেশের শাসকের যে নিরপেক্ষতা পালন করা কর্তব্য সেই বার্তাও দিয়ে যায়।