আত্মহত্যার অরণ্য। এই নামেই বনটিকে চিহ্নিত করেন স্থানীয় মানুষেরা। নিজের হাতে নিজের প্রাণ নেওয়ার মতো ভয়ংকর কাজটি করার জন্য এই বনকেই যে বেছে নেন সেখানকার শয়ে শয়ে মানুষ। আবার সেই আত্মহত্যার সঙ্গে নাকি সম্পর্ক রয়েছে দুটি উপন্যাসেরও! কী এমন রহস্য রয়েছে এই বনে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একদিকে সবুজের সমুদ্র। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া দৃশ্য। কিন্তু তার মধ্যেই মাঝে মাঝে এমন কিছু জিনিসের দেখা মেলে, যে, শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় ঠান্ডা শিহরন। এই বনে ঢোকার মুখেই দেখা মেলে অসংখ্য পরিত্যক্ত গাড়ির। বনের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ পায়ে ঠেকে কারও পরিত্যক্ত জামাকাপড়, জুতো, ব্যাগ, ঘড়ি, কিংবা এমনই কোনও ব্যক্তিগত জিনিস। যেন সেসব হঠাৎ করেই ফেলে রেখে চলে গিয়েছে কেউ। কিন্তু সে যে আর কোনও দিন এসব জিনিসের কাছে ফিরে আসবে না, সে কথাও যেন লেখা রয়েছে তাদের গায়ে। এমন গা ছমছমে অনুভূতি হয় বলেই জাপানের আওকিগাহারা বনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে ‘শয়তানের বন’ তকমা।
আরও শুনুন: মৃত্যুর আগেই নিজের মৃতদেহের মুখোমুখি, অলৌকিক অভিজ্ঞতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
শোনা যায়, এই অরণ্যের আনাচকানাচে নাকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য মানুষের লাশ। হ্যাঁ, কথাটা সত্যিই। প্রতি বছর গড়ে অন্তত ৫০টি মৃতদেহের হদিশ মেলে এই বনে। আর প্রত্যেকটি মৃত্যুই অস্বাভাবিক। আরও আশ্চর্যের কথা হল, এইসব মৃত্যুর দায় নাকি আসলে দুটি উপন্যাসের! অন্তত এমনটাই দাবি করে থাকেন অনেকে। এই দুটি উপন্যাসই দুই জাপানি লেখকের লেখা। একটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬০ সালে, আরেকটি ১৯৯৩ সালে। কিন্তু এই দুটি উপন্যাসের মধ্যেই রয়েছে এক অদ্ভুত মিল। প্রথম বই, সেইচো মাতসুমোতোর লেখা ‘কুরোয় কাইজু’ উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, এই বনে এসেই আত্মহত্যা করেন নায়ক নায়িকা। আবার ‘দ্য কমপ্লিট সুইসাইড ম্যানুয়াল’ নামের বইটিতেও জাপানি লেখক ওয়াতারু তসুরুমুই ‘দ্য পারফেক্ট প্লেস টু ডাই’ অর্থাৎ আত্মহত্যার সঠিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন এই বনকেই। কেউ কেউ দাবি করেন, সাহিত্যের সূত্রে পাওয়া ওই কথাকেই আঁকড়ে ধরেন হতাশ মানুষেরা। জীবনের প্রতি ভালবাসা ফুরিয়ে গিয়েছে যাঁদের, বই দুটি যেন তাদের পথনির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশ জীবনের দিকে নয়, মৃত্যুর অভিমুখে। বনে পড়ে থাকা বেশ কয়েকটি মৃতদেহের পাশে ওই দ্বিতীয় বইটি পাওয়ার জেরে এই ভাবনার পালে জোর হাওয়া লেগেছিল। অবশেষে দুটি বইকেই নিষিদ্ধ করা হয় সে দেশে। কিন্তু তাতেও কমেনি মৃত্যুর সংখ্যা। ১৯৭০ সাল থেকেই প্রতি বছর একবার করে তল্লাশি চালানো হয় এই বনে। সরকারি পরিসংখ্যান জানায়, সময় যত গড়িয়েছে ততই যেন বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। ২০০২ সালে এই বনে পাওয়া যায় ৭৮টি মৃতদেহ, ২০০৩ সালে ১০০টি এবং ২০০৪ সালে ১০৮টি। তবে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় ২০১০ সাল। সে বছর এই বনে এসে আত্মহত্যা করেন ২৪৭ জন মানুষ।
আরও শুনুন: সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে ‘মারণ-জলাশয়’! কাছে গেলেই কেন মৃত্যু সামুদ্রিক প্রাণীর?
আসলে যাঁরা এই চরম পথ বেছে নেন, তাঁরা কোথাও না কোথাও গিয়ে নিজেদের সম্পূর্ণ একা বলেই মনে করেন। কিন্তু একাকিত্বের যন্ত্রণায় জীবনকে নিজের হাতে শেষ করে দিলেও মৃত্যুর মুহূর্তে হয়তো সেই বেদনা আরও তীব্র হয়ে আসে। সেই কারণেই হয়তো এই বন হয়ে ওঠে তাঁদের অন্তিম গন্তব্য, যে বনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একইভাবে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া অসংখ্য মানুষের স্মৃতি। সেই মৃত মানুষদেরই শেষ মুহূর্তের কিংবা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সঙ্গী বলে মনে করেন এই যন্ত্রণাকাতর মানুষেরা, এমনটাই জানিয়েছিল আওকিগাহারা বন প্রসঙ্গে এক সমীক্ষা।