বর্তমানে ঈশ্বরের চারপাশে ক্রমশ এক গণ্ডি টেনে দিতে চাইছেন অনেকে। বাস্তব জগতের ছোঁয়া মাত্র পেলেই যেন আহত হবে ঈশ্বরের মহিমা। এই প্রবণতার জেরে সংকটে পড়ছেন তাঁরা, যাঁরা নিজেদের রসিকতার পরিসরে ধর্ম বা ঈশ্বরকেও অনায়াসে ঠাঁই দেন। অথচ, সম্প্রতি খোদ ধর্মগুরুই আশ্বাস দিলেন, ঈশ্বরকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা যায় বইকি।
ঈশ্বরকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করলেই সমূহ বিপদ! ভগবানকে অপমান করা হয়েছে, এই মর্মে রে রে করে উঠবেন একদল ভক্ত। বা বলা ভালো, উঠছেন। হ্যাঁ, ইদানীং কালেই লাফিয়ে বেড়েছে এই প্রবণতা। অথচ, সম্প্রতি খোদ ধর্মগুরুই আশ্বাস দিলেন, ঈশ্বরকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা যায় বইকি। তিনি তো কাছেরই মানুষ, আর প্রিয়জনকে নিয়ে ঠাট্টা করা যাবে না? মনে পড়তে পারে, ঠিক এ কথাই তো কবে বলে গিয়েছেন আমাদের কবি। রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে বলেছেন, “দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই/ প্রিয়জনে— প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই/ তাই দিই দেবতারে”; আর এই দেওয়া এত সহজ হয়ে ওঠে কারণ দেবতাই যে আসলে প্রিয়। প্রিয়জন।
আরও শুনুন: এত লেখার থেকে ডিম সেদ্ধ বিক্রি করলেও হত! ছোটদের সঙ্গে মশকরা রসিক বন্ডের
হ্যাঁ, এমন ভাবনা কিন্তু এককালে ভাবতেন অনেকেই। সারা পৃথিবীর শিল্প সাহিত্যের দিকে তাকালেই তা নজরে পড়ে। যাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাঁরাও ঈশ্বরকে নানা অবতারে দেখতে চেয়েছেন নিজেদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। শুধুমাত্র এ দেশের প্রেক্ষিতে দেখলেও তাই খুঁজে পাওয়া যায় রামকথার এক-একরকম পাঠ। কোথাও কবি রামকে নরকুলচন্দ্রমার আসন দিচ্ছেন, তো কোথাও সীতা বর্জনের জন্য তিরস্কার করতেও ছাড়ছেন না। কোথাও আবার দেবীর জবানিতে শিবকে বুড়ো বর থেকে নেশাড়ু, কোনও কিছু বলতেই বাদ রাখছেন না কবি। আবার উনিশ শতকেই, ইউরোপিয়ান ধাঁচে আঁকা দেশি শিল্পীর ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নেশাতুর শিবের পিছনে সিংহকে তাড়া করার নির্দেশ দিয়েছেন খোদ দেবী দুর্গা। গ্রিক আর রোমান পুরাণ জুড়ে তো দেবতাদের দোষ ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে, তা পরবর্তীকালে ঠাট্টার প্রসঙ্গেও উঠে এসেছে। ইহুদিদের ওল্ড টেস্টামেন্টে খোদ আব্রাহামের স্ত্রীই কিনা সারাক্ষণ স্বামীর কাজে নাক গলান, প্রায় গুপ্তচরের মতো নজর রাখেন যাতে পরে তাঁকে বকাবকি করা যায়। উদাহরণ না বাড়িয়েও বলা যায়, সব দেশে সব ধর্মেই এ প্রবণতা কম বেশি দেখা গিয়েছে। ঈশ্বরকে কাছের মানুষ করে ভাবার এও এক প্রকাশ বইকি।
আরও শুনুন: হাসপাতেলে মৃত্যুশয্যায় বাবা, ICU-তেই বিয়ে সারল দুই মেয়ে
কিন্তু বর্তমানে পালটে গিয়েছে সময়টাই। সেখানে ঈশ্বরের চারপাশে ক্রমশ এক গণ্ডি টেনে দিতে চাইছেন অনেকে। যেন তাঁকে মানুষের হাসি-দুঃখ-ক্ষোভ সবকিছুর ছোঁয়াচ থেকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাস্তব জগতের ছোঁয়া মাত্র পেলেই যেন আহত হবে ঈশ্বরের মহিমা। এই প্রবণতার জেরে সংকটে পড়ছেন তাঁরা, যাঁরা নিজেদের রসিকতার পরিসরে ধর্ম বা ঈশ্বরকেও অনায়াসে ঠাঁই দেন। সম্প্রতি কমেডিয়ানদের এক আসরে তা নিয়েই কথা বললেন খোদ পোপ ফ্রান্সিস। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ঈশ্বরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করলেই কি তাঁকে অপমান করা হয়? রসিকতা কাউকে অপমান করে না, খাটোও করে না। তিনি মনে করেন, রসিকতার জোরে যদি একজন মানুষের মুখেও হাসি ফোটানো যায়, তবে কোথাও না কোথাও, ঈশ্বরের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। হ্যাঁ, শালীনতার সীমা বজায় রাখার কথাটিও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন বটে। কিন্তু ঈশ্বরকে নিয়ে তামাশা মাত্রেই তা অপমানজনক, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই, আশ্বাস খোদ ধর্মগুরুরই।