বন্ধ হোক যুদ্ধ! দাবি ছিল স্রেফ এটুকুই। তার জন্য বন্দি হতে হল। সহ্য করতে হল অত্যাচার। কারণ এই দাবি যে বা যারা তুলছে তারা সবাই সেই দেশের বাসিন্দা যে দেশের সরকার যুদ্ধ চায়। সুতরাং যুদ্ধের বিরোধিতা মানে দেশদ্রোহিতা। কিন্তু অত্যাচার করে কি প্রতিবাদ থামানো যায়? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
যারা যুদ্ধে যায় তারা যুদ্ধ চায় না। এ কথা সর্বতোভাবে সত্য। নানা ঘটনার প্রসঙ্গ ধরে ব্যাপারটা প্রমাণ করা যেতে পারে। তবে শুধু সৈনিক নয়, সাধারণ মানুষও চায় না যুদ্ধ (Israel-Palestine Conflict) হোক। হতেই পারে নিজের দেশ যুদ্ধে জিতছে, হতেই পারে শত্রুদেশ কার্যত ধুলোয় মিশেছে, তবু যুদ্ধ থামার আর্জি রাখেন অনেকে। রাষ্ট্রের চোখে এরা দেশদ্রোহী। তাতে সমস্যা নেই। সকলেই যেন পণ করেছেন, এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার!
ইতিহাস সাক্ষী আছে, বিশ্বের সেরার সেরা প্রেমপত্রগুলো লেখা হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। এবং সেসব যারা লিখেছিলেন তাঁরা সবাই চেয়েছিলেন যুদ্ধ থামুক। সামনে থাকা শত্রু যে কোনও মুহূর্তে বন্দি করতে পারে, প্রাণটাও কেড়ে নিতে পারে, তবু যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দুকের বদলে কলম তুলে নিয়েছিলেন এঁরা। সবাই ভুলে গেলেও ইতিহাস এঁদের মনে রেখেছে, সাহিত্য এঁদের মনে রেখেছে। আগামীতেও হয়তো মনে রাখবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে তাঁরা সাহিত্যিক নন। সাধারণ মানুষ। তফাৎ বলতে, ভাবনায়। নিজের দেশ অন্য একটা দেশকে ধ্বংস করছে এমনটা কোনওভাবেই মানতে পারছেন না এঁরা। তাই পথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন। তাতে অত্যাচার সইতে হলেও প্রতিবাদ থেকে সরে আসার কথা ভাবছেন না কেউ।
আসলে এ হল নতুন ভোরের ইঙ্গিত। যুদ্ধ কখনও সমাধানের পথ নয়, এ কথা প্রমাণ করার লড়াই। যে লড়াই লড়ছে ইজরায়েলের তরুণ তুর্কিরা। কিছুদিন আগে অবধি সেইভাবে যুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামাত না এদের অনেকেই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মন। গাজার ধ্বংসচিহ্ন আর সহ্য করতে পারছে না ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ। তাই যুদ্ধ (Israel-Palestine conflict) বন্ধের দাবিতে চলছে প্রতিবাদ। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এরা প্রতিবাদ করছে। তাতে শামিল হতে পারে যে কেউ। স্রেফ ভাবনায় মিল থাকলেই এক পথের যাত্রী হতে পারে সবাই। যদিও এই পরিবর্তন হঠাৎ বা আকস্মিক নয়। এর আগেও যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদ দেখেছে বিশ্ব। এমনকি জনপ্রিয় সংস্থা মাইক্রোসফটের কর্মীরাও সরব হয়েছিলেন এই নিয়ে।
আচ্ছা, অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? ইজরায়েলি আক্রমণে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক, শিশু, নারী, বৃদ্ধ। আকাশচুম্বী অট্টালিকা, আবাসন মুহূর্তে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে পড়ছে খেলনা বাড়িঘরের মতো। নেটদুনিয়ায় ‘ভাইরাল’ হওয়া প্রতিটি ভিডিও জানাচ্ছে, প্যালেস্তাইনের রং পাকাপাকিভাবে ধূসর হয়ে গিয়েছে। এই সময় বাকি পৃথিবীর সকলের পক্ষে কি চুপ থাকা সম্ভব, নাকি উচিৎ? মানবিকতা যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে বোধহয় চুপ করে থাকা আদতে আধিপত্যের হাত-ই শক্ত করা। আর তাই, প্রতিবাদ ঘনিয়ে উঠছে। সে প্রতিবাদ হতে পারে ব্যক্তিগত স্তরেও। সেই নমুনাই রেখেছিলেন মাইক্রোসফট কর্মীরা। সেই প্রতিবাদই জারি রাখছেন ইজরায়েলের তরুণরা।
সারা পৃথিবী জুড়ে এই মুহূর্তে আধিপত্যকামী শক্তির দাপট। রাজনৈতিক কারণ অবশ্যই রয়েছে। তবে, রাজনৈতিক পরিধি পেরিয়েও যা থেকে যায়, তা হল মানবিকতার প্রসঙ্গ। বিশ্বের যেখানেই মানবতা বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত হয়, মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে। সে প্রতিবাদ অবশ্য সবসময় যে হয়ে-ওঠে তা নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ এসে প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বাধ্যবাধকতার জায়গা এসে কণ্ঠস্বর থামিয়ে দেয়। তবু, শেষ পর্যন্ত মানুষের পক্ষে থাকে মানুষই। ইজরায়েলের তরুণরা ভালোমত জানেন তাঁদের প্রতিবাদ মানুষনিধন যজ্ঞ থামাতে পারবে না। কিন্তু অগণিত মানুষকে সাহস আর শক্তি দেবে আধিপত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার ক্ষেত্রে। হয়তো এই প্রতিবাদের কারণে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতিও স্বীকার করতে হবে বা হচ্ছে। তবে, এখানেই যেন জেগে ওঠে সেই শাশ্বত কথা- সবার উপরে মানুষ সত্য।