সম্প্রতি নয়া সংসদ ভবনের ছাদে বসল ৯৫০০ কেজি ওজনের ব্রোঞ্জনির্মিত অশোক স্তম্ভ। যা নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে ঘনিয়ে উঠেছে নয়া বিতর্কও। যে প্রতীক মৈত্রীর বার্তা বহন করছে, সেই মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে বিরোধীদের আমন্ত্রণ না জানানোকে গণতন্ত্রবিরোধী বলেই কটাক্ষ করেছেন বিরোধীরা। আসলে ঠিক কী বার্তা তুলে ধরে ঐতিহ্যশালী এই অশোক স্তম্ভ? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বর্তমানে ৯৫০০ কেজি ওজন এবং সাড়ে ছয় মিটার উঁচু অশোক স্তম্ভের নির্মাণ যেভাবে সকলকে বিস্মিত করেছে, তেমনই অবাক লাগে আদি অশোক স্তম্ভের দিকে দৃষ্টি ফেরালেও। যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও তিনশো বছর আগে তৈরি করা সেই স্তম্ভগুলির প্রত্যেকটির ওজন ছিল ৫০ টন, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কেজি। দেশের একাধিক স্থানে স্থাপন করা ওই স্তম্ভগুলির মধ্যে বর্তমানে মাত্র উনিশটির খোঁজ মেলে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই ওই বিশাল স্তম্ভগুলিকে উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় কীভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, তা এক রহস্য। এও আশ্চর্যের কথা যে, ৪০ থেকে ৫৫ ফিট পর্যন্ত উঁচু এই স্তম্ভগুলির নির্মাণে কোনোরকম ঢালাই-এর বালাই ছিল না। বরং তৈরি হয়েছিল মাত্র এক খণ্ড পাথর খোদাই করেই। কিন্তু কেন এমন বিরাট প্রকল্প নিয়েছিলেন ওই স্তম্ভের নির্মাতা, সম্রাট অশোক? সে উত্তর আসলে রয়ে গিয়েছে অশোক স্তম্ভের আকার এবং তার গায়ে খোদাই করা বাণীর মধ্যেই। সেই আমলের অন্যান্য রাজারাজড়ার মতো বিজয়ের স্মারক নয়,- বরং হিংসা, দমন ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধ স্বর হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল এই স্তম্ভগুলি।
আরও শুনুন: শাহজাহান একা নন, ‘তাজমহল’ বানিয়েছিলেন আরও অনেকেই! কোথায় কোথায় রয়েছে সেগুলি?
ব্যক্তিগত বোধ, প্রজ্ঞা আর উপলব্ধিকেই এই স্তম্ভের মধ্যে দিয়ে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন মহামতি অশোক। আর তিনি সেই বোধে পৌঁছেছিলেন ধর্মের পথ ধরে। ধর্ম কথাটির প্রকৃত অর্থ, যা ধারণ করে। মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ গুণগুলিকেই ধারণ করে ছিল অশোকের সেই ধর্ম বা ‘ধম্ম’। আসলে এর সম্পূর্ণ বিপরীত পথেই তাঁর উত্থান ঘটেছিল বলেই হয়তো এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে ভুল হয়নি তাঁর। ক্ষমতার সঙ্গে রক্ত, হানাহানি, হিংসা যেভাবে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে থাকে, নিজের জীবনেই তা দেখেছিলেন রাজার ছেলে অশোক। সিংহলের উপাখ্যান মতে, নিজের ১০০ ভাইয়ের মধ্যে ৯৮ জনকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন অশোক। তা ছাড়া তাঁর কলিঙ্গ অভিযানের দরুন অন্তত এক লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এত বীভৎসতা ক্রমশ চণ্ডাশোককে ঠেলে দিয়েছিল অহিংসার পথে, এমনটাই জানা যায়। অবশেষে করুণাঘন বুদ্ধের অহিংসা ধর্মে আশ্রয় খুঁজে পান তিনি। এদিকে দেশজুড়ে তখন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাধান্য। দেবতার উদ্দেশে বলি দান, জাতিভেদ ও বর্ণাশ্রম প্রথা, সবকিছুই চলছে রমরমিয়ে। এই পরিস্থিতিতে নিজের রাজত্ব জুড়েও অহিংসার বার্তা প্রচার করতে চেয়েছিলেন সম্রাট অশোক। আর সেই বার্তাবহ হিসেবেই ওই আকাশছোঁয়া স্তম্ভগুলি নির্মাণ করেন তিনি।
আরও শুনুন: কুতুব মিনার কি আদৌ দিল্লিতে ছিল! বিষ্ণুর সঙ্গেই বা কী যোগ এই স্তম্ভের?
গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্থান, বৌদ্ধ তীর্থস্থান ও বৌদ্ধবিহারগুলিতে স্থাপিত স্তম্ভগুলির অধিকাংশের গায়ে লেখা ছিল অহিংসা, শান্তি আর মৈত্রীর বার্তা। আর ওই স্তম্ভের শীর্ষে থাকত একটি বিশেষ প্রতীক। সেগুলি কমবেশি একরকম হলেও সারনাথের অশোক স্তম্ভের শীর্ষটিকেই বর্তমানে ‘অশোক স্তম্ভ’ বলে চিহ্নিত করা হয়, এবং তা দেশের জাতীয় প্রতীকও বটে। ২ মিটারের চেয়েও বেশি উঁচু এই ভাস্কর্যটি মাত্র একটি বেলেপাথর খোদাই করেই নির্মাণ করা হয়েছিল। একেবারে নিচে রয়েছে পদ্মফুল, যা পবিত্রতার প্রতীক। এর উপরের অংশে একটি হাতি, একটি ঘোড়া, একটি ষাঁড় ও একটি সিংহের মূর্তি খোদিত রয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে একটি করে ধর্মচক্র। আর এই সবকিছুর উপরে চারটি এশীয় সিংহ পরস্পরের দিকে পিঠ করে চারদিকে মুখ করে বসে রয়েছে। বলা হয়, ওই চারটি সিংহ আসলে শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস এবং গর্বের প্রতীক। বস্তুত ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী হাতি, ঘোড়া, ষাঁড় ও সিংহ ধৈর্য, গতি, বীর্য এবং শৌর্যেরই প্রতীক। এই সমগ্র প্রতীকটির মাধ্যমে একইসঙ্গে অহিংসা এবং আত্মশক্তির বার্তা দিয়েছিলেন সম্রাট অশোক। অহিংসার অর্থ যে ভয় নয়, বরং হিংসুক প্রবৃত্তিগুলি জয় করে অন্তরের শক্তিকে পরিস্ফুট করে তোলা, সেই কথাই জানায় অশোক স্তম্ভের এই বিশেষ প্রতীকটি।