প্রবীণের প্রেম এখন আর লুকোছাপার বিষয় নয়। অনেক বাধা পেরিয়ে প্রবীণরা যেন বলে উঠতে পেরেছেন,মনেরে আজ কহ যে, ভাল মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে। আর জীবনে প্রেমের থেকে বড় সত্য আর কী আছে!
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘জানি না বয়স হলে কেন প্রেমে এত পাক ধরে’… গেয়েছিলেন আমাদের নাগরিক কবিয়াল। তবে কিনা বয়সকালের প্রেম নিয়ে, আমাদের সমাজে যেন একটু কিন্তু-কিন্তু, লুকোছাপা ভাব। একটা আধটা ‘চিনি কম’-এর মতো সিনেমা হয় বটে; তা নিয়ে কথাও হয়। তবে ওই পর্যন্তই! সামাজিক বাধানিষেধের গণ্ডি পেরিয়ে কেউই যেন বেশি বয়সের প্রেমকে স্বীকার করতে চান না। অনেকরকম ছুঁতমার্গ বয়সকালের প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। বিশেষত ভারতবর্ষের মতো দেশের সামাজিক অবস্থায় মনের কথা মনে লুকিয়েই কাটিয়ে দেন প্রবীণরা। ধরে নেওয়া হয়, সঙ্গীবিহনে একাকী কাটানোই বোধহয় বয়সকালের নিয়তি। আসলে, পরিবারের ধারণা আমাদের মধ্যে এমন ভাবেই বসে আছে যে, ধরে নেওয়া হয় যে, ব্যক্তিগত অনুভবকে গুরুত্ব দিলে বুঝি বা সেই ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর তাই ‘লোকে কী ভাববে’ এই মতামতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের ভাবনা-অনুভব জলাঞ্জলি দিয়ে থাকেন অনেকেই।
আরও শুনুন: ‘যাঃ’ মানেই ‘হ্যাঁ’! প্রেমে ডুবে মরা বাঙালির আজব কিস্সা
তবে, সেই দিনকাল ক্রমশ বদলাচ্ছে।
আজকাল অনেকেই কিন্তু বেশি বয়সের প্রেমকে অস্বীকার করছেন না। এমনকী বিয়ের মতো সামাজিক বাঁধনেও বাঁধা পড়ছেন। এই তো বছরখানেক আগের কথা। ৭৫ বছরের বাবুরাও পাটিল, বিয়ে করলেন অনুস্যা শিন্ডেকে, কনের বয়স তখন ৭০। দুজনের দেখা হয়েছিল এক বৃদ্ধাবাসে। বাবুরাওয়ের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, আর স্বামীকে হারিয়েছিলেন অনুস্যা। দুজনে যেন শেষজীবন কাটাতেই গিয়েছিলেন বৃদ্ধাবাসে। তবে, বানপ্রস্থেও এল বসন্ত। বছর দুয়েক একসঙ্গে বসবাস করতে করতে বুঝতে পারেন, দুজনেই মনের দিক থেকে অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছেন। ফলত বয়স আর সেখানে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বয়সের কথা মাথাতেও রাখেননি দুজনে। বাঁধা পড়েছিলেন বিয়ের বাঁধনে। তাঁদের সেই সিদ্ধান্ত, অনেককেই প্রেরণা দিয়েছিল। অনেকেই যেন বুঝতে পারছিলেন, প্রেমেরে বিদায় করে দেশন্তরে একা একা বেলা কাটানোর সত্যিই কোনও অর্থ হয় না।
আসলে বয়সকালের নিসঃঙ্গতার অনেক রকম পরত। কেউ যদি নিজেকে একাকী রাখতে চান তো আলাদা কথা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় হয়ে ওঠে সামাজিকতার চাপ। সমাজের কথা ভেবে, পরিবারের মন রাখতে গিয়ে নিজের মনের কথাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ হতেন অনেকে। সেই ধারণা অনেকটাই বদলেছে। সম্প্রতি যেমন অভিনেতা আশিস বিদ্যার্থী ৫৭ বছর বয়সেও দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন। তবে, শুধু তিনি নন। সঙ্গীকে হারিয়ে একদা তলিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের প্রেমকে এখন অনেকটাই গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রবীণরা। তাঁদের জন্য তৈরি ডেটিং সাইটগুলির জনপ্রিয়তাও সেই কথাই বলছে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই ধরনের সাইটে প্রবীণের আনাগোনা হয়তো ক্লপনার বাইরেই ছিল। তবে, নেটদুনিয়া যেন দরজা খুলে দিয়েছে একাকীত্ব কাটানোর। ভারতবর্ষেও এরকম একাধিক সাইট আছে, যার মাধ্যমে সঙ্গীহীন প্রবীণরা বন্দুত্ব করতে পারেন কারও সঙ্গে। বয়স তো নয়ই, ভৌগলিক দূরত্বও আর সেখানে বাধা হয়ে থাকছে না।
আরও শুনুন: স্বামী না ফিরলে উপবাসে মৃত্যু স্ত্রীর! পাখিদের প্রেমেও আছে নিজস্ব ভাষা
এই বিষয়ে দুরন্ত একটি পদক্ষেপ করেছেন মহারাষ্ট্রের মাধব দামলে। তিনিও একটি বৃদ্ধাবাসের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। দেখলেন, সেখানে প্রবীণরা ক্রমশ একাকিত্বের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। একে তো সঙ্গী নেই, উপরন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের সদ্ভাবও নেই। একজন তো আত্মহত্যা করতেই গিয়েছিলেন। মাধব ভেবেছিলেন, এই নিঃসঙ্গ মানুষরা যদি পরস্পরের মধ্যে সঙ্গী খুঁজে নেন, তাহলে মন্দ হয় না! সেই ভাবনায় কাজ দিয়েছে। আজ তাঁর উদ্যোগের সূত্রে বহু নিসঃঙ্গ প্রবীণই আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।
প্রবীণের প্রেম তাই এখন আর লুকোছাপার বিষয় নয়। অনেক বাধা পেরিয়ে প্রবীণরা যেন বলে উঠতে পেরেছেন,মনেরে আজ কহ যে, ভাল মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে। আর জীবনে প্রেমের থেকে বড় সত্য আর কী আছে!