ভোটের ময়দানে মাছ মাংসই যেন হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক হাতিয়ার। আমিষ-নিরামিষে দ্বন্দ্ব কম বাধেনি ভোটের হাওয়ায়। অথচ ভোটপণ্ডিতরা বলছেন, ভোটের খেলা ঘোরাতে হাজির ছিল ডাল রুটি সবজিও। কীভাবে? শুনে নিন।
ভোটের ময়দানে মাছ মাংসের কথা তুলে বিরোধীদের নিশানা করাটা একরকম অভ্যাস করে ফেলেছিলেন মোদি। যেন দেশে যা কিছু খারাপ ঘটছে, সবেরই দোষ একা আমিষের। কখনও রাহুল-লালুর শ্রাবণ মাসে মাংস রান্নার ছবি, কখনও আবার তেজস্বীর নবরাত্রির সময় মাছ খাওয়া, একযোগে সবকিছুকেই তুলোধোনা করেছেন তিনি। একে ‘মুঘল মানসিকতা’ বলে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েননি। রাজনৈতিক মহলের মত, এ সবকিছুর মধ্যে দিয়েই আসলে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের রাজনীতিতে আরও শান দিতে চেয়েছিল বিজেপি। যাতে সেই বিভাজনের পাখায় ভর করেই ভোট কুড়িয়ে নেওয়া চলে গোটা দেশ থেকে। আমিষকে হাতিয়ার করেই তাই ভোটের খেলা ঘোরানোর চেষ্টা ছিল পুরোমাত্রায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্রেফ আমিষ নয়, ভোটের খেলায় বড় ঘুঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরামিষও। তবে মোদিরা যেভাবে চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে নয়। আমিষকে কাঠগড়ায় তুলে নিরামিষ থেকে যে ভোট দখল করতে চেয়েছিল বিজেপি, ভোটপণ্ডিতেরা বলছেন, সেই নিরামিষের ভোটও অনেকাংশে গিয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধেই।
কীভাবে ঘটল এমনটা?
আরও শুনুন:
আমিষ-নিরামিষে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ! বহু রূপে সম্মুখে ফিরছে জাতের ভাগাভাগিই?
আসলে দেখা যাচ্ছে, মোদি জমানায় নিরামিষ খাবারের দামও যে লাফিয়ে বেড়েছে। গোবলয়ের মতো, দেশের যেসব এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ নিরামিষ খান, তাঁদের মূল খাদ্য রুটি, সঙ্গে ডাল সবজি। অন্যান্য জায়গায় রুটির বদলে ভাতও থাকে খাদ্যতালিকায়। কিন্তু বিগত এক বছরেই এই প্রত্যেকটি খাদ্যদ্রব্যের দাম হুহু করে বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির হারই দুই অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনও একটি জিনিসকে বিজেপির মুখ থুবড়ে পড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করতে হয়, তা অবশ্য খাবারের মূল্যবৃদ্ধি।
উনিশের লোকসভা ভোটের আগের এক বছরে খাবারের দাম বাড়ার হার ছিল কমবেশি ০.০৩ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালের মে মাস থেকে চব্বিশের এপ্রিল পর্যন্ত হিসেব করলে দেখা যাবে, সেই মূল্যবৃদ্ধির হারটাই গড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৮৮ শতাংশ। কনজিউমার ফুড প্রাইস ইনডেক্স হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, ধান-গমের মতো দানাশস্যের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার ১০.৩৯%, ডালজাতীয় শস্যের বেলায় তা ১৬.০৭ শতাংশ আর আনাজপাতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি, ১৮.৩৩ শতাংশ। বলা হচ্ছে, মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে খাবারের মূল্যবৃদ্ধির হার আদৌ এত বেশি ছিল না। টানা পাঁচ বছরে তা চার শতাংশেরও নিচে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বারের শাসনকালে সেই ছবিটাই পুরো উলটে গিয়েছে। সেখানে খাবারের মূল্যবৃদ্ধির হার গড়েই দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশে।
আরও শুনুন:
মাছ, মাংস, মিষ্টি… স্বাদের আহ্লাদও আসর মাতাচ্ছে ভোট-রাজনীতির
মানুষ কী খাবে, তা বেঁধে দেওয়াকে সাধারণত কোনও মানুষই ভালো চোখে দেখেন না। কারণ খাদ্যাভাসের সংস্কৃতি রাতারাতি তৈরি হয় না, এক দিনে তা বদলানোও যায় না। একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সেই অঞ্চলের মানুষের খাওয়া-দাওয়ার প্রকৃতি নির্ভর করে। খাদ্য সংস্কৃতিতে নিরামিষ-আমিষের বৈচিত্র্য ভারতে বহুদিনই ছিল, কিন্তু গোটা দেশেই আমিষবিরোধী হাওয়া তোলার প্রয়াস আসলে বিরোধিতাই বাড়িয়েছিল। কিন্তু মানুষ কী খাবে, তার চেয়েও তো বড় কথা, সে আদৌ খেতে পাবে কি না। খাবারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তো সেই নিশ্চিন্তিতেই আঘাত হানে। পেটের টানই যে সবচেয়ে বড় টান, সে আর কে না জানে! জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যত কথাই হোক, খাবারের দাম বাড়া আসলে মানুষকে আরও গভীরে গিয়ে আঘাত করে। খাবারের দাম বাড়লে তাই আমজনতার হেঁশেলে আগুন নিভে আসে, বদলে জ্বলে ওঠে তার মন। সেই প্রতিবাদের তোড়ই এবার ছাপ ফেলেছে ভোটবাক্সে, তেমনটাই আন্দাজ করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ স্রেফ আমিষ নয়, ভোটের হাওয়াবদলের দায় অনেকখানি বর্তেছে নিরামিষের উপরেও।