ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমান। তিনি কিনা কথা বলছেন অন্যের বাপবাপান্ত করে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘আদিপুরুষ’ ছবিতে হনুমানের মুখে বসানো একটি সংলাপ এই মুহূর্তে নেটদুনিয়ায় ভাইরাল। তা দেখে অনেকেই তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন। সত্যিই কি হনুমান ‘বাপ তুলে’ কথা বলার মতো চরিত্র! স্বয়ং বাল্মীকি তাঁকে কীভাবে এঁকেছেন রামায়ণে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
‘কাপড়া তেরা বাপকা, তেল তেরে বাপকা, আগ ভি তেরি বাপকি, জ্বলেগি ভি তেরি বাপকি’ – অর্থাৎ কাপড়, তেল, আগুন সবই যখন তোর বাপের তখন তোর বাপের জিনিসই জ্বলবে-পুড়বে। এ-কথা বলছেন স্বয়ং বজরংবলী! আদিপুরুষ সিনেমায় হনুমানের মুখে আছে এমনই সংলাপ। যা শুনে তো দর্শক রীতিমতো হতবাক! সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ মশকরা করে বলেছেন, স্বয়ং ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমানের মুখে এমন সংলাপ শুনে মানুষ তো মঙ্গলবারের উপোশ করতেই ভুলে যাবে! সিনেমা যা-ই দেখাক না কেন, স্বয়ং বাল্মীকি কিন্তু হনুমানকে মোটেই এভাবে কল্পনা করেননি। তাহলে বাল্মীকি রামায়ণে হনুমান ঠিক কীরকম? রাম ও লক্ষ্মণ দুজনেই তাঁকে পরম ‘বিদ্বান’ হিসাবেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। যাঁর মুখে একটিও ‘অপশব্দ’ নেই।
আরও শুনুন: Ramayana: রামায়ণের আদিতে ছিলই না লক্ষ্মণরেখা! কোথা থেকে এল এই গল্প?
সুন্দরকাণ্ডে যখন এই লঙ্কাদাহ হচ্ছে তখন হনুমান এরকম কোনও কুকথাই বলেননি। বরং দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন। বিভীষণের উপদেশে দূতকে বধ করা হবে না বলেই ঠিক করলেন দশানন। কিন্তু নিগ্রহ করতে হবে, এমনটাই দস্তুর। যেহেতু লেজ বানরদের অতিপ্রিয়, তা-ই তাঁর লেজে আগুন দিয়ে তাঁকে বিকলাঙ্গ করে তোলা হবে বলে মনস্থ করলেন লঙ্কাধিপতি। তাঁর নির্দেশে যখন হনুমানের লেজে কাপড় জড়িয়ে তা তৈলাক্ত করে অগ্নিসংযোগ করা হল, হনুমান তখন ভাবছিলেন, চাইলে তিনি এই রাক্ষসদের বধ করতেই পারেন। নিজেকে বন্ধনমুক্ত করতে পারেন। কিন্তু তা তিনি করবেন না। কেননা রামের হিতসাধনের জন্যই তা না-করা তাঁর কর্তব্য। বরং যেহেতু তাঁর লেজে আগুন দিয়ে সারা লঙ্কা ঘোরানো হবে, অতএব এই অবকাশে তিনি লঙ্কাপুরী বেশ ভাল করে দেখে নিতে পারবেন। রাক্ষসীর মুখে হনুমানের এই নিগ্রহের খবর শুনে মা সীতা প্রার্থনা করলেন হুতাশনের উদ্দেশে। বললেন, যদি আমি তপস্যা করে থাকি, যদি আমি পতিব্রতা হই, তবে অগ্নিস্পর্শে যেন হনুমানের অঙ্গ শীতল হয়। হনুমান দেখলেন, লেজে আগুন জ্বলা সত্ত্বেও তাঁর অঙ্গ দগ্ধ হচ্ছে না। বরং তুষারপাতের মতো শীতলতা অনুভব করছেন তিনি। তিনি বুঝলেন, সীতার দয়া, রাঘবের তেজ আর তাঁর পিতার কৃপায় অগ্নিতে তাঁর কোনও ক্ষতিসাধন হচ্ছে না। এর কিছু পরেই ঘটবে লঙ্কাদহন। কিন্তু সিনেমায় যেমনটা দেখানো হয়েছে, এই পুরো পর্বে হনুমান কারও উদ্দেশে খারাপ কথা বলছেন, কটূক্তি করছেন এমনটা বাল্মীকি অন্তত দেখাননি।
আরও শুনুন: রামভক্ত বানরের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর তুলনা! ‘আদিপুরুষ’ নিয়ে টুইট করে বিপাকে যুবক
সত্যি বলতে, বাল্মীকির হনুমান বেদজ্ঞ, বিদ্বান মানুষ। কোনওরকম ‘অপশব্দ’ প্রয়োগই করেন না। যাঁকে প্রথমবার দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন রামচন্দ্র। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে সুগ্রীবের সচিব হয়ে রাম ও লক্ষ্মণের সামনে এলেন হনুমান। অনুমান সুবক্তা ছিলেন। তাঁর কথা শুনেই রামচন্দ্র বুঝেছিলেন যে, ইনি বেদজ্ঞ। বাল্মীকি রামায়ণে রামচন্দ্র হনুমানকে দেখে যা বলেছিলেন, রাজশেখর বসুর সারানুবাদে তা এইরকম,- “হনুমানের কথা শুনে রাম পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মণকে বললেন, যে সুগ্রীবের সঙ্গে আমরা মিলিত হতে চাই ইনি তাঁরই সচিব। তুমি এঁর সঙ্গে মিষ্ট কথায় আলাপ কর। ইনি যেরূপ কথা বললেন, ঋক্ যজুঃ ও সামবেদ জানা না থাকলে সেরূপে কেউ বলতে পারে না। ইনি নিশ্চয় বহুবার সমগ্র ব্যাকরণ শুনেছেন সেজন্য একটিও অপশব্দ বলেননি, এঁর মুখ চক্ষু, ললাট ভ্রূ প্রভৃতিরও কোনও বিকৃতি দেখা গেল না। ইনি সংক্ষেপে অসন্দিগ্ধভাবে যথাক্রমে শব্দসকল উচ্চারণ করেন, সমস্ত ধ্বনি যথাস্থান থেকে যথাযথ নির্গত হয়। এঁর বাক্য দ্রুত নয়, বিলম্বিতও নয়, শুনলে মনে আনন্দ হয়।’ অর্থাৎ হনুমান শুধু বেদজ্ঞ ছিলেন তাই নয়, সংস্কৃত ভাষায় তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। তাঁর শব্দ উচ্চারণ থেকে ব্যাকরণ জ্ঞান, সবেতেই মুগ্ধ হয়েছিলেন রামচন্দ্র। আর তাই পরবর্তী সময়ে লক্ষ্মণ তাঁকে নিসংকোচে ‘বিদ্বান’ বলে সম্বোধন করেছেন।
সেই সংস্কৃতজ্ঞ, বেদজ্ঞ হনুমান ‘বাপ তুলে’ প্রায় ‘রকের ভাষায়’ কথা বলছেন, এ যেন ভাবাই যায় না। অথচ পরিচালক তা ভেবে সিনেমাতে দেখিয়েও দিয়েছেন। যাঁরা বাল্মীকির হনুমানকে চেনেন তাঁরা দুঃখিত হবেন এই হনুমানকে দেখে। হচ্ছেনও। এই ধরনের সংলাপে শুধু হনুমান নয়, স্বয়ং বাল্মীকিরও অপমান। তবে সুবিধা এই যে মানহানির মামলা রুজু করতে তিনি তো আর বেঁচে নেই! কিন্তু তাই বলে কি মানহানি চলতেই থাকবে! হাসি-মশকরার তলে তলে সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেল।