কেবল চুলের সজ্জার দিকে তাকালেও দেশের প্রাচীন সংস্কৃতির একরকম ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। খোলা চুল বা চুল না রাখা বা কোনও বিশেষ কায়দায় চুল বাঁধা অনেক সময়েই হয়ে উঠেছে কোনও না কোনও বিশেষ ইঙ্গিত। আর সেইসব ইঙ্গিতই পরবর্তী দিনে ধারণ করে রেখেছে ইতিহাসের আখ্যানকে।
অপমানের প্রতিশোধ না মেলা পর্যন্ত বাঁধব না চুল। দ্রৌপদীর এই প্রতিজ্ঞা মিথ হয়ে গিয়েছে মহাভারতে। পাশা খেলায় পাণ্ডবদের সব হারানো আর তারপর দুঃশাসন তাঁকে টেনে প্রকাশ্য রাজসভায় নিয়ে আসার পর, অপমানিতা দ্রৌপদী এই শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু কেবল তিনিই নন। ইতিহাস বলে, একই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন খোদ চাণক্য। রাজা নন্দের কাছে অসম্মান পেয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, নন্দবংশের ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত চুল বাঁধবেন না। দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন ভারতে খোলা চুল কেবল কেশসজ্জার রীতি মাত্র নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিদ্রোহের গল্পও। আবার, এই ভারতবর্ষেই বৌদ্ধ-জৈনরা মুণ্ডিতমস্তকে ঘুরে বেরিয়েছেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মাথা মুণ্ডন করে তাতে শিখা বা টিকি রেখেছেন, সন্ন্যাসীরা চুল না কেটে বা তার পরিচর্যা না করে জটা রেখেছেন। শিখ ধর্মের মানুষেরা আবার চুল না কাটাকেই ধর্ম বলে মনে করেছেন। সব মিলিয়ে এ কথা বোঝা যায়, যে, কেবল চুলের সজ্জার দিকে তাকালেও দেশের প্রাচীন সংস্কৃতির একরকম ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। খোলা চুল বা চুল না রাখা বা কোনও বিশেষ কায়দায় চুল বাঁধা অনেক সময়েই হয়ে উঠেছে কোনও না কোনও বিশেষ ইঙ্গিত। আর সেইসব ইঙ্গিতই পরবর্তী দিনে ধারণ করে রেখেছে ইতিহাসের আখ্যানকে।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা- এ কথা কেবল বনলতা সেন নয়, মানুষের সামগ্রিক ইতিহাসের বেলাতেও কম সত্যি নয়। প্রাচীন ইতিহাস থেকেই দেখা যায়, চুল আর তার সজ্জার ধরনধারণ নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম নেই। এ দেশও সেই আগ্রহে শামিল আদি যুগ থেকেই। পুরোনো ছবি মূর্তি ভাস্কর্য থেকে তার প্রমাণ মেলে। যেমন, গুপ্তযুগের পার্বতীর টেরাকোটা মূর্তিতে দেখা যায় সামনের চুল মাথার ওপর আংটির মতো করে প্যাঁচানো, বাকি চুল ঘাড়ের পেছনে গোছা করা। চালুক্য আমলে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত বাদামীর গুহা মন্দিরে এক দুর্গামূর্তির মাথায় দেখা যায়, অনেকটা টোপরের আকারে মাথার ওপর চুল তুলে বাঁধা হয়েছে। নাট্যশাস্ত্রে একে বলা হয়েছে সমুন্নধ শিখাণ্ডক। আবার এখানেই এক অপ্সরা মূর্তির মাথায় গোল খোঁপা, তাতে জড়ানো মালা।
শতপথ ব্রাহ্মণ আর বাজসনেয় সংহিতায় পাওয়া যায় স্তূপ কেশপাশের উল্লেখ। মহাভারতে আছে বেল্লিত কেশপাশ, অর্থাৎ মাথার সামনের দিকে চুল আঁকাবাঁকা রেখায় সাজিয়ে মাথার ডানপাশে একটা ভারী খোঁপা বাঁধা। মহাভারতই বলেছে, রম্ভার মাথায় থাকত পঞ্চচূড়া, অর্থাৎ মাথার ওপর একত্রে পাঁচটি খোঁপা বাঁধা। নাট্যশাস্ত্র অংশুক কেশপাশের কথাও বলে, অর্থাৎ কাপড় দিয়ে চুল বাঁধা। নাট্যশাস্ত্র বলে, আভীর রমণীরা নাকি একটুকরো কালো কাপড় দিয়ে এই রীতিতে চুল বাঁধতেন।
এইসব রীতির অনেকটাই নাহয় আপাতভাবে সাজসজ্জার সঙ্গে যুক্ত। তবে কেশসজ্জার সূত্রেই সেকালে মানুষকে চিহ্নিত করার পথও ছিল। যেমন খোলা চুল বা মস্তকমুণ্ডন দুই-ই ধর্মীয় ভাবে মানুষের পৃথক থাকার ইশারা দিত। যে নারীরা শোকপালন করতেন, কিংবা যারা রজস্বলা, তাদের খোলা চুলে থাকাই নিয়ম ছিল। পুরনো ভাস্কর্যে দেখা যায়, সঙ্গমরত বা কামনামদির যুগলদের চুল ঢেউখেলানো, অর্থাৎ এমন চুলের ধরনেই ওই প্রকৃতির যুগলদের চিহ্নিত করছেন শিল্পী। আবার যে সেনারা আত্মসমর্পণ করছে, সেই বশ্যতার চিহ্ন বহন করত তাদের খোলা চুল। সন্ন্যাসীদের মতোই রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত বা পলাতকদেরও জটা থাকত অনেকসময়। উপনয়ন, দীক্ষা এমন বিবিধ ধর্মীয় কারণে মস্তকমুণ্ডন হত, হত শ্রাদ্ধ করার জন্যে, আবার কোনও বড় অপরাধের শাস্তি হিসাবেও মাথা কামিয়ে দেওয়া হত। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা আর ধর্ম তো বটেই, এমনকি বিদ্রোহ বা শাস্তির রকমফেরও চিনিয়ে দিচ্ছে কেশসজ্জাই। আর এমন করেই, কেবল সাজ নয়, সংস্কৃতির নানারকম চিহ্ন ধরে রেখেছে প্রাচীন ভারতের কেশসজ্জার রীতিগুলি।