কলকাতা আর হায়দরাবাদের টক্কর। যাকে বলে সেয়ানে সেয়ানে! তবে শুধু ক্রিকেটের মাঠ নয়, বিরিয়ানির প্লেটেও। স্বাদে, সূক্ষ্মতায়, সঙ্গতে কেউ যেন কাউকে এক ইঞ্চি প্লেট ছাড়তে নারাজ। তাতে লাভ অবশ্য ভোজনরসিকদেরি। যেমন বিশ-বাইশের যুদ্ধে যে-ই জিতুক, লাভ ক্রিকেটপ্রেমীদেরই। স্বাদ-আহ্লাদের সেই যুদ্ধেরই হালহকিকত জানালেন সৌরাংশু।
কলকাতা আর হায়দরাবাদের সম্পর্কের কথা উঠলেই যেন চলে আসে ইডেন গার্ডেন্সের কথা। জয়সীমা, পতৌদি, আজহার, লক্ষ্মণ আর কিংসওয়েটা পেরোলেই এপারে বলরাম, নইমুদ্দিন, হাবিব আর আকবর। বস্তুত, জয়সীমাকে বলা হয়েছিল যে, ‘ইডেন গার্ডেন্স মাঠটা দুর্দান্ত’। আর তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ দুর্দান্ত, হায়দরাবাদীদের জন্য’! তখন থেকেই বোধহয় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।
তবে, সম্পর্ক তো শুধু মাঠে নয়! কলকাতা আর হায়দরাবাদ তো বিরিয়ানিতুতো সহোদর। দুটো শহরের লোকই বিরিয়ানি বলতে পাগল। হায়দরাবাদের ‘কাচ্চি’ বিরিয়ানি আর কলকাতার মাটন বিরিয়ানি আলু ও ডিম-সহ– দুই শহরের রসনার সদরপথকে আসনাই দিয়ে মুড়ে রেখেছে। ডেগচি আর হাঁড়ি একটু বেঁকিয়ে বসিয়ে তাতে দম দেওয়া আর ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে রান্না, এই যদি হয় হায়দরাবাদি বিশেষত্ব; তাহলে কলকাতা তার মোলায়েম স্বাদ আর মশলার সূক্ষ্ম ব্যবহার দিয়ে মাতিয়ে দেয় বিরিয়ানির অন্দর।
তাহলে ‘তরিকা’? কলকাতা বিরিয়ানির ক্ষেত্রে বাসমতী বা লম্বা দানার যে কোনও সুগন্ধি চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পাশাপাশি মাংসের বড় বড় টুকরো দই, নুন, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো মাখিয়ে ম্যারিনেট করতে হবে। ডিম সিদ্ধ করে রাখতে হবে আগেভাগে, আলু দু’টুকরো করে কেটে ম্যারিনেট করে রাখতে হবে। বিরিয়ানির সুগন্ধের মূল কথা হল ‘বারিস্তা’ বা পেঁয়াজ ভাজা। লম্বা লম্বা সরু সরু পেঁয়াজ বেশি আঁচে তেল বা ঘিতে ফেলে তারপর আঁচ কমিয়ে নুন আর চিনি দিয়ে কড়কড়ে করে ভাজা। আর সেই তেলেই আলু ভেজে রাখা। ডিম তো সিদ্ধ করে রাখাই আছে। তারপর ভাত রান্না করতে হবে এমন ভাবে যাতে চাল গলে না যায়! মাংস রান্না করতে হয় পেঁয়াজ আদা রসুন গরমমশলা দিয়ে। তারপর বড়সড় গভীর পাত্রে ঘি মাখিয়ে ভাত ও মাংসের স্তর তৈরি করে মাঝে মাঝে আলু, ডিম সিদ্ধ আর পেঁয়াজ ভাজা দিতে হয়। অতঃপর তা দমে রান্না করা। শেষে কেওড়া ও গোলাপ জল দিয়ে নামিয়ে নেওয়া। চাইলে দুধে কেসর গুলেও দেওয়া যায়।
বিরিয়ানি তো চাপিয়ে দেওয়া হল। এই অবসরে বরং ইতিহাসে অলিগলি একটু ঘুরে দেখা যাক। সালটা ১৭৫৩, অযোধ্যায় তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। নবাব আসফউদ্দৌল্লা সেই সময় শুরু করলেন এক উদ্ভট প্রকল্প। কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প। ইমামবাড়া তৈরি হবে। যারা কাজ করবে, তারাই খেতে পাবে। অতএব দিনের বেলা একদল যা তৈরি করত, রাত্রে আরেক দল তা ভেঙে দিত; লাভের লাভ এই যে, দুই দলই খেতে পেত। এইভাবেই কাজ চালানো হয়েছিল বহু বহু বছর ধরে, যাতে শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকে। শ্রমিকদের খাবারের জন্য বরাদ্দ ছিল দু’টুকরো মাংস আর ভাত। নবাবী খানসামা কোনোরকমে চাল, মাংস আর কিছু মশলা দিয়ে হাঁড়ি দমে বসিয়ে দিত। হাঁড়ি থেকে যা বেরোত, সেটাই নাকি আজকের লখনউ-ই বিরিয়ানি। ঠিক একই কারণে লখনউ অঞ্চলে খানদানি বাড়িতে দাওয়াত হলে বিরিয়ানি নাস্তি। পোলাও হবে, কিন্তু বিরিয়ানি নৈব নৈব চ। কারণ, ওটা ‘গরিবের খাবার’।
সেই অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ যখন কলকাতায় এলেন, মেটিয়াবুরুজে তৈরি হল আর এক লখনউ। এল বাইজি নাচ, এল বুলবুলির, মোরগের লড়াই, এল ঘুড়ি আর এল– বিরিয়ানি। কিন্তু সে বিরিয়ানির সামগ্রী কোত্থেকে আসবে? ভাণ্ডারের টান ভাঁড়ার অবধি পৌঁছেছে। তাই একটুকরো মাংসের পরিবর্তে চলে এল আলু। কলকাতা বিরিয়ানি যে কুর্নিশ আদায় করে নিল, তা তার স্বপ্নিল সুগন্ধ, হালকা আমেজ আর ফুরফুরে বাসমতীর জন্য নয়, নয় তুলতুলে রেওয়াজির জন্যও; তার পরিচিতি মূলত বিরিয়ানির আলুতেই, সেখানেই তার বিশেষত্ব।
আর হায়দরাবাদি কাচ্চি? বড়সড় গভীর পাত্রে বেশ ভালমতো দই ও আদা রসুন পেঁয়াজ বাটা এবং পুদিনা পাতা ও অন্যান্য গরমমশলা দিয়ে, ম্যারিনেটেড মাংস নিচে দিয়ে, তার উপর চাল দিয়ে, পাত্রটি একটু হেলিয়ে হালকা আঁচে দমে রান্না করতে হয়। আর মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে দিতে হয়। শেষে নামানোর আগে কেওড়া ও গোলাপ জল ছড়িয়ে নামিয়ে নেওয়া। ও হ্যাঁ, হায়দরাবাদি মশলায় কর্নাটকের বিশেষ শুকনো লঙ্কার আধিক্য। অর্থাৎ মশলাটা একটু চড়ার দিকে থাকে, সূক্ষ্মতার জায়গায় স্বাদের প্রাচুর্যই তার মাথার মণি।
সপ্তদশ শতকে মোগলরা হায়দরাবাদ দখল করলে, সেখানকার রাজত্ব দেওয়া হয় নিজাম-উল-মূলককে। তারপর বংশপরম্পরায় মোগল সংস্কৃতি দাক্ষিণাত্যের উষ্ণতায় মাখিয়ে, বর্ষায় সিঞ্চিত হয়ে হায়দরাবাদি নিজামী সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ১৮৫৭-য় মুঘল সাম্রাজ্যের সরকারি ভাবে পতন ঘটলে লখনউকে ছাপিয়ে হায়দরাবাদ দক্ষিণ এশীয় ইসলামিক সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসাবে উঠে আসে। মীর অসমান আলী বা আসফ জা সপ্তমের আমলেই এই বিরিয়ানি তার নিজস্বতা পায় এবং শোহরত হাসিল করে।
তবে, সূক্ষ্মতা বনাম প্রাচুর্য শুধু নয়। কলকাতা এবং হায়দরাবাদি বিরিয়ানির সঙ্গতের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আছে। লখনউয়ের আদলে যখন কলকাতা বুরহানি রায়তায় মন দিয়েছে, হায়দরাবাদ সেখানে সালানকে নিজের শিরস্ত্রাণ উপহার দিয়ে দিয়েছে। রায়তার কথা তো প্রায় সকলেই জানেন। সাদা দই পাতলা করে ঘেঁটে নিয়ে তাতে হয় রসুন, শসা কাঁচালঙ্কা দিয়ে লহ্সুনই রায়তা করা যায়। অথবা শুকনো লঙ্কা, জিরে শুকনো খোলায় নেড়ে তাতে আদাবাটার ‘ছৌঁক’ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বুরহানি রায়তা।
আর সালান? চিনে বাদাম নারকেল কোরা আর সাদা তিল শুকনো খোলায় নেড়ে নিতে হয়। পেঁয়াজ কুঁচি আদা রসুন বাটা ভাল করে তেলে কষে নিতে হবে। এরপর সবগুলি উপাদান মিক্সিতে ঘুরিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিতে হয়। কাঁচা লঙ্কা শুকনো খোলায় হালকা নেড়ে নিন। এরপর পেস্টটি তেলে দিয়ে নেড়ে তাতে লঙ্কাগুলি দিয়ে দিতে হয়। তারপর আন্দাজমতো তেঁতুল জল নুন হলুদ দিয়ে লঙ্কা সিদ্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। তেল ছেড়ে দিয়ে সালান ঘন হয়ে গেলেই মির্চ-কা-সালান বা লঙ্কার সালান রেডি।
আসলে তুলনা চলে না, তর্ক চলে না। কলকাতার মানুষ যেমন তাদের আলু দেওয়া সূক্ষ্ম স্বাদের বিরিয়ানিকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে, নবাবের শহর মিয়াঁ, হায়দরাবাদি লাল হলুদ কমলা আর বাদামির প্রাচুর্য ভরা সুগন্ধি বিরিয়ানির ধারে কাছে কিছু আসে বলে মনে করে না।
আর সংখ্যালঘু প্রকৃত ভোজনরসিক? কলকাতা না হায়দরাবাদ– কার কাছে কোনটা প্রিয়? সে ‘চয়েস’ একান্তই ব্যক্তিগত।
শুরু হয়েছিল ক্রিকেটের গল্প দিয়ে, শেষটাও তা দিয়েই হোক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫-০ সিরিজ হারার পর বিসিসিআই ১৯৬২-৬৩ মরসুমের জন্য চার ওয়েস্ট ইন্ডিয় ফাস্ট বোলারকে রঞ্জি খেলাতে নিয়ে আসে। বাংলার হয়ে লেস্টার কিং, রয় গিলক্রিস্ট হায়দরাবাদ, দিল্লির হয়ে চেস্টার ওয়াটসন আর বোম্বের হয়ে চার্লি স্টেয়ার্স। ৬২-৬৩র কোয়ার্টার ফাইনালে কিং আর গিলক্রিস্ট মুখোমুখি। যদিও বাংলা জিতেছিল পঙ্কজ রায়ের জোড়া সেঞ্চুরিতে তবু ইডেনের সবথেকে বেশি হাততালি তোলা ছিল ভারতীয় ফুটবল অধিনায়ক চুনী গোস্বামীর জন্য। চুনী সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে করেন ৪১ আর দুই ইনিংসে ৩টি উইকেট নেন। গিলক্রিস্টের আগুনের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলার অধিনায়ক পঙ্কজ রায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইডেন নিজের ছেলেকেও সম্মান জানাতে ভোলে না। সে পঙ্কজ রায়, চুনীই হোক আর হাল আমলের সৌরভ, পাপালি বা মনোজ। আজহার, লক্ষ্মণ, হাবিব বা নইমকে ভালবাসলেও শহর নিজের ছেলেদেরও ভোলে না।
অনেকদিন পর আবার কলকাতা আর হায়দরাবাদে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর। খেলার হারজিত খেলাতেই ঠিক হবে। বিরিয়ানি নিয়ে তর্কও আগের মতোই থেকে যাবে। তবে যা-ই হোক না কেন, ভোজনরসিকদের কাছে যে শেষ পর্যন্ত বিরিয়ানিরই বাজিমাত হবে, তা বলাই যায়।