খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, ওয়ানড়ে বিপর্যয়ের আগেই ধস নামার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল কেরল সরকারকে। অথচ উদাসীন ছিল সরকার। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা নিয়ে যে উদাসীন হওয়া চলে না, আর কত প্রাণ ঝরে গেলে সে কথা বুঝব আমরা?
সোনম ওয়াংচুক যখন হিমালয়কে রক্ষা করার দাবিতে টানা ২১ দিন ধরে অনশনে বসে ছিলেন, সেই সময়েই প্রশ্ন উঠছিল- যেখানে সোনম ওয়াংচুক নেই, সেখানে পরিবেশ বেশ আছে তো? তা যে নেই, নতুন করে সে কথা বুঝিয়ে দিল কেরলের ওয়ানড়। যদিও সোনম ওয়াংচুক না থাকলেও, পরিবেশবিজ্ঞানীরা তো আছেন। তাঁরা গবেষণার ভিত্তিতে সরকারকে সতর্ক করে থাকেন মাঝেমধ্যেই। এর আগে সেই পূর্বাভাসে কান না দিয়ে কখনও মাশুল গুনেছে কেদারনাথ, কখনও উত্তরাখণ্ড, কখনও যোশীমঠ, আর এবার ওয়ানড়ের নামও জুড়ে গেল সেই তালিকায়।
-: আরও শুনুন :-
যেখানে সোনম ওয়াংচুক নেই, সেখানে পরিবেশ বেশ আছে তো?
একদিকে অতি ভারী বৃষ্টি, অন্যদিকে পরপর ধস- দুয়ে মিলে করাল গ্রাসে ছবির মতো সুন্দর কেরলের পাহাড়ি উপত্যকা ওয়ানড় জেলা। লাফিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা, আহত বহু, এখনও নিখোঁজ শতাধিক মানুষ। পাহাড় ফাটিয়ে নেমে আসা জলের তোড়ে ২২ হাজার মানুষের কলরবে মুখর ৪টি গ্রাম মাত্র ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই উবে গিয়েছে। যেমনটা ১১ বছর আগে গিয়েছিল কেদারনাথে। সেবারেও অতিবৃষ্টির জেরে হড়পা বান নেমে এসেছিল গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে। উত্তরাখণ্ডের চামোলি, রুদ্রপ্রয়াগ এবং উত্তরকাশী ভেসে গিয়েছিল। কিছুদিন আগেই উত্তরাখণ্ডেও যেমন ধস আর বৃষ্টি ডেকে এনেছিল বিপর্যয়। ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৩৭৮২টি ভূমিধসের মধ্যে ২২৩৯টি ধসের মুখোমুখি হয়েছে কেরল। যা দেশে সর্বোচ্চ। এবারেও ওয়ানড়ের মুন্ডাক্কাই, চুরুমালা, আট্টামালা এবং নুলপুঝা নামে চারটি গ্রামের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। অথচ বৃষ্টির তথ্য যাচাই করে এবং ধসের প্রবণতা বিচার করে আগেই মুন্ডাক্কাই এলাকাকে বসবাসের অযোগ্য বলে সতর্ক করেছিলেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। এই বিপর্যয়ের পর খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, কেরলে অত্যধিক বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। তার প্রভাবে যে ধস নামতে পারে, আগেই তা বোঝা গিয়েছিল। ধস নিয়ে অন্তত এক সপ্তাহ আগে সতর্ক করা হয়েছিল পিনারাই বিজয়ন সরকারকে। এমনকি, কেন্দ্র থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ন’টি দলকেও আগেভাগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেরলে। কিন্তু এত কিছু করা সত্ত্বেও সময়ে ব্যবস্থা নেয়নি কেরল সরকার, অভিযোগ শাহের।
তবে এবেলা শাহ যতই বাম সরকারের দিকে আঙুল তুলুন না কেন, কেন্দ্র নিজেও কি সবসময়ে সময়মতো ব্যবস্থা নিয়ে থাকে? মনে করে নেওয়া যাক, জোশীমঠে যখন মাটি বসে যাচ্ছিল আচমকা, জানা যায় তার আগেই এ নিয়ে কেন্দ্রকে সতর্ক করেছিল ইসরো। দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে উপগ্রহের পাঠানো ছবি প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, যেখানে সাত মাস ধরে যোশীমঠের মাটি বসেছিল ৯ সেন্টিমিটার, সেখানে হঠাৎ ১২ দিনের মধ্যে ৫.৪ সেন্টিমিটার মাটি বসে গিয়েছে, আর এই ঘটনা রীতিমতো ভয়ের। অথচ প্রতিবেদন প্রকাশের পরই আসে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের ফরমান, মাটি বসে যাওয়া নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কিছু বলা বা সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করা চলবে না। অতঃপর রাতারাতি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে তুলে নেওয়া হয় প্রতিবেদনটিকে। শুধু যোশীমঠও তো নয়। বিগত কয়েক বছরে বারবার ধস নামার প্রবণতা দেখে পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন যে, যথেচ্ছ উন্নয়ন বা শিল্পের বাড়াবাড়ি বিপদ ডেকে আনবে। কিন্তু তারপরেও, সে কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি প্রশাসন। এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, মানে একটা বড়সড় উন্নয়নের কাজ করতে গেলেই পরিবেশের উপর তার ফলাফল বিচার করা-র যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা ইতিমধ্যেই নাকচ করেছে কেন্দ্র। এর মধ্যে এলাকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়ার বিষয়টিও ছিল। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদিই জানিয়ে দিয়েছেন, কারখানা কিংবা রাস্তা বানানোর জন্য, নগরায়ণ বা শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনে জঙ্গল কাটতে হলে সেখানে বসবাসকারীদের অনুমতি নেওয়ার কোনও দরকার হবে না। তাঁদের কেবল কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াই যথেষ্ট। অর্থাৎ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষা’ বিষয়ে যেসব কাজকে ক্ষতিকারক ও বেআইনি করে রাখা হয়েছিল, গত কয়েক বছরে তার প্রত্যেকটিকে আইনি করে নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বিপর্যয় সংক্রান্ত বিশ্লেষণের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে অনেকানেক রাজনীতির খেলা। সত্যি বলতে, বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ, ধরন এবং পর্যায়গুলির যথাযথ বিশ্লেষণ সম্পন্ন হলে তবেই তার ভিত্তিতে অনুরূপ বিপর্যয় মোকাবিলার কাজটি সহজ হয়। তাতে নাগরিকেরাও সজাগ হন, সরকারের পক্ষেও পরিকল্পনার পথ খোলে। অথচ পরিবেশ নিয়ে সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ, পরিকল্পনার অভাব, পুঁজিবাদী লোভের মূল্য দিতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দা এবং মরশুমি পর্যটকদের।
-: আরও শুনুন :-
World Water Day: অবাক জলপান! জলের দরে আর মেলে না জল
পরিবেশভাবনার ছিটেফোঁটা না রেখে বিকাশের বুলডোজার চালালে যে আদতে আমাদের সকলেরই বিপদ, সে কথা বোঝাতেই লড়াই জারি রেখেছেন সোনম ওয়াংচুক। এখনও। কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে তো একাধিক সোনম ওয়াংচুক নেই। সেই বাকি দেশেও যে পরিবেশ বেশ নেই, সে কথাই নতুন করে বুঝিয়ে দিল ওয়ানড়ের রাতারাতি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়ে যাওয়া।