আসুন, আমাকে চড় মারুন! প্ল্যাকার্ডে এ কথা লিখেই রাজধানীর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন তরুণী। কিন্তু কেন যেচে চড় খেতে চাইছেন তিনি? সে কথা বরং শুনেই নিন।
এক গালে চড় খেলে অন্য গাল বাড়িয়ে দাও! জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এর দৌলতে এ কথা অনেকেরই চেনা। কিন্তু বাস্তবে কেউ যেচে চড় খেতে চাইবেন কেন! দু’গাল দূরের কথা, এক গালেও চড় খাওয়ার শখ কারই বা আছে! সেখানে এই তরুণী একেবারে জলজ্যান্ত ব্যতিক্রম। তিনি যেচেই চড় খেতে চান, তাও আবার চেনা অচেনা যে কোনও লোকের কাছ থেকেই। অন্তত সেই বক্তব্যওয়ালা একটি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়েই রাজধানীর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন তিনি। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘স্ল্যাপ মি’, অর্থাৎ ‘আমাকে চড় মারুন’।
আজগুবি নয়, সত্যিই এমনটা ঘটেছে রাজধানী দিল্লিতে। ভাসিমা ড্যাঞ্চ (Vaseema Danc) নামের ওই তরুণীকে দেখা গিয়েছে, সত্যি সত্যিই এমন প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আরও আশ্চর্যের কথা হল, তাঁর এই নির্দেশ পালন করার মতো লোকও যে নেই, তা নয়। ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, পথচলতি অনেক আগন্তুকই এই প্ল্যাকার্ডের লেখা পড়ে তাঁর কাছে এসে চড় মেরেছেন। কেউ আস্তে, কেউ জোরে। কেউ জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন, প্ল্যাকার্ডের নির্দেশটি সত্যি কি না। নিশ্চিত হয়ে তাঁরাও চড় মেরেছেন ওই তরুণীকে।
যদিও এ গল্পের একটা উলটো পিঠ আছে। ঠিক যেমন প্ল্যাকার্ডেরও থাকে উলটো পিঠ। আর সেই পিঠে লেখা ছিল, ‘১০০ টাকা দিন’! হ্যাঁ, চড় খাওয়ার পরেই প্ল্যাকার্ডের উলটো দিক দেখিয়েছেন তরুণী। হতচকিত আগন্তুকেরা বুঝেছেন, এ আসলে একরকমের তামাশা ছিল, আর তাঁরা সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। বোঝার পর কেউ টাকা দিয়েছেন, কেউ আবার টাকা না দিয়েই পত্রপাঠ পিছু ফিরেছেন। তবে ওই তরুণী কি নিছক টাকা তোলার উদ্দেশ্যেই এহেন তামাশা করেছেন? তা কিন্তু নয়। জানা গিয়েছে, যেটুকু টাকা পেয়েছেন, তা দিয়ে পথবাসী গৃহহারা দুঃস্থ মানুষদের বিস্কুট ও অন্যান্য খাবারই কিনে দিয়েছেন ওই তরুণী।
নিজে চড় খেয়ে তার বিনিময়ে টাকা তুলেই দুঃস্থ মানুষদের সাহায্য করা, এই আচরণ আমাদের চমকে দেয় তো বটেই। একইসঙ্গে আমাদের চমকে দেয় তরুণীর উলটোদিকে থাকা মানুষগুলির আচরণও। ওই যে, প্ল্যাকার্ডের মতো, সব ঘটনারও তো দুটো পিঠ থাকে। তার একদিকে আমরা দেখি পথহারা মানুষদের প্রতি সংবেদন, যার জন্য নিজে আহত হতেও আপত্তি নেই একজনের। অন্যদিকে দেখি কিছু মানুষেরই চূড়ান্ত অসংবেদন, যার জেরে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন পথচলতি মানুষকেও শারীরিকভাবে আঘাত করা যায়। এমনকি কোনও কিছু পাওয়ার আশা না থাকলেও। সত্যি বলতে, আজকাল ব্যস্ত রাস্তায় সাহায্যের প্রয়োজন হলেও অনেক মানুষই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন না, এ কথা তো আমরা জেনেই গিয়েছি। মানুষ সাহায্য চাইলে কেউ হাত বাড়াবেন না, অথচ মানুষ আঘাত চাইলে সে নির্দেশ মানবেন, এমনই এক অদ্ভুত অসংবেদনের ছবি তুলে ধরছে এই ঘটনা। সার্বিয়ার শিল্পী মেরিনা আব্রামোভিচ একবার এমনও একটি সামাজিক পরীক্ষা করেই দেখিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ছ’ঘণ্টা তিনি মঞ্চে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আর ওই ছ’ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে পারেন দর্শকেরা। সামনে রাখা গোলাপ, পালক, সুগন্ধি থেকে শুরু করে কাঁচি, পেরেক, বন্দুকের যা কিছু দর্শকেরা তাঁর উপর ব্যবহার করতে পারেন, এ কথাও বলা হয়। সেখানেও দেখা গিয়েছিল, বহু দর্শক উন্মত্তের মতোই নির্যাতন চালিয়েছিল ওই শিল্পীর উপর।
আরেকজনের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো ভালোবাসা-সংবেদনের পাশাপাশি এই হিংস্র প্রবৃত্তিও হয়তো সব মানুষের অন্তর্নিহিত সত্যি। ফারাক কেবল নির্বাচনের। সে কথাই বোধহয় আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন দিল্লির এই তরুণীও।