কলকাতা শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রংবেরঙের ইতিহাস। নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা জাতের মানুষকে আপন করে নিতে কোনও দিনই দ্বিধা করেনি এ শহর। আর সবটা মিলে তৈরি হয়েছে এক অভিনব বর্ণালি। সেই ইতিহাসেরই একটুকরো এখনও বেঁচে রয়েছে মধ্য কলকাতায়। প্রতি বছর বড়দিনের মরশুমে নস্টালজিয়ার আঁচ পোহায় সে জায়গা। শুনে নেওয়া যাক তার কথা।
এ শহর হাজারও গল্প বুকে বয়ে নিয়ে চলে। তাদের ভুলে থাকা যায়, কিন্তু মুছে দেওয়া যায় না। প্রতি বছর বড়দিনের সময়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে ওঠে তেমনই এক গল্প। কোথায়? কলকাতা শহরের ব্যস্ত অফিসপাড়ার মধ্যেই সেই গল্পের বাস। যে জায়গার পোশাকি নাম বো ব্যারাক।
আরও শুনুন: শুধু শীতের আমেজে বিকিকিনি নয়, কোন উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল পৌষমেলা?
কিন্তু, লন্ডন শহরের সাবেকি রাস্তা বো স্ট্রিটে-এর নামে কলকাতায় রাস্তা গজিয়ে উঠল কেন? আসলে এই রাস্তা তৈরি করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা তো আদতে সেখানকার মানুষই। বিশ্বযুদ্ধে যে আমেরিকান সেনারা অংশ নিয়েছিল, তাদের একত্রে রাখার জন্য এই রাস্তার দুপাশে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কয়েকটি একটানা বাড়ি। সেনাবাহিনীর পরিভাষায় যাকে বলে ব্যারাক। বিশ্বযুদ্ধ মিটল। আমেরিকান সেনারাই শুধু নয়, তার পরে পরে এ দেশ ছেড়ে বিদায় নিল ব্রিটিশরাও। অর্থাৎ বাড়ির বাসিন্দা আর মালিক, উভয়েই। ফাঁকা পড়ে রইল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের গড়া এই ইমারতগুলো। তখন সেখানেই আস্তানা গাড়লেন কলকাতায় জন্ম নেওয়া সাহেব-মেমরা, খাঁটি সাহেবরা যাঁদের কোনও দিনই নিজেদের আত্মীয় বলে স্বীকার করেনি। যাঁদের আমরা চিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলে। যাঁরা কালো চামড়া বা সাদা চামড়া কোনও দলেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন না, তাঁরা এই গণ্ডিটুকুর মধ্যে জিইয়ে রাখলেন নিজেদের সংস্কৃতি।
তাই আজও বড়দিনে এই একচিলতে গলিতে নেমে আসেন ঈশ্বরপুত্র। রাস্তাজোড়া আলোর সাজে, বাড়িতে বানানো কেক পেস্ট্রি ওয়াইনের স্বাদে, যিশুকে স্বাগত জানায় বো ব্যারাক। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ রাতভর গানবাজনা চলে। ‘মিউজিক্যাল নাইট’-এ ব্যারাকের যুবকদের নিজস্ব ব্যান্ডের পারফরম্যান্স থাকে। আর জড়ো হয় বাচ্চারা। পথশিশুদের মুখে খাবার তুলে দেন ব্যারাকের অধিবাসীরা। ২৪ তারিখ ‘মাস’। সন্ধেবেলায় স্লেজে চড়ে এসে উপস্থিত হন সান্তা ক্লজ, উপহার দিয়ে যান শিশুদের। পার্ক স্ট্রিটের সাহেবিয়ানার পাশাপাশি এই মহল্লার মাটিছোঁয়া উৎসবের স্বাদ পেতে ভিড় জমায় কলকাতা।
আরও শুনুন: বৈশাখ নয়, সেকালে বাংলার নববর্ষ শুরু হত অগ্রহায়ণেই
বাড়িগুলো এখনও রয়েছে বটে, তবে রক্ষণাবেক্ষণের বালাই নেই। ভাড়ার প্রশ্নও নেই। সরকারি তরফে বাড়িগুলো ভেঙে ফেলে পুনর্বাসনের প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু তাতে রাজি হননি এই এলাকার বাসিন্দারা। পায়রার খোপের মতো ছোট ছোট ফ্ল্যাটগুলোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়ে গিয়েছে ১৩০-১৩২টা পরিবার। আর তাঁদের মধ্যে দিয়েই এ কলকাতার মধ্যে বেঁচে রয়েছে আরেকটা কলকাতা।