ভোপালের কুখ্যাত গ্যাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। অথচ গ্রেপ্তার হয়েও রীতিমতো সরকারি সহযোগিতায় বিদেশে পাড়ি দেন অভিশপ্ত কারখানার চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসন। সেই ভয়ংকর ঘটনাকে ফিরে দেখলেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
আজ থেকে ঠিক ৪০ বছর আগে৷ ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর গভীর রাত আর ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে ঘটেছিল দুর্ঘটনা৷ মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড রাসায়নিক ফ্যাক্টরির ‘প্ল্যান্ট নাম্বার সি’ থেকে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস নির্গত হয়েছিল৷ বাতাসে এই গ্যাস মিশে গেলে, সেই বায়ু মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু নিশ্চিত। সেটাই ঘটেছিল সেই অভিশপ্ত দিনে৷
অথচ সেই ভয়াবহ ঘটনার পরেও, ইউনিয়ন কার্বাইডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসন পার পেয়ে যান৷ ভোপালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বটে। কিন্তু দিল্লি থেকে আসা এক রহস্যজনক ফোনের দৌলতে তাঁর ‘সেফ প্যাসেজ’-এর ব্যবস্থা হয়ে যায়৷ কর্পোরেট ক্রিমিনালটি প্লেনে চড়ে এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান মার্কিন মুলুকে৷ তারপর বিচারের জন্য বারবার ডাকা হলেও তিনি এ দেশে আসেননি৷
ঘটনার তদন্তে জানা যায়, ‘প্ল্যান্ট নাম্বার সি’-তে জলের সঙ্গে মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস মেশানো হয়েছিল৷ মিশ্রণজনিত কারণে গ্যাস ঘনীভূত হতে থাকে৷ একটা সময়ে গ্যাসের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে ট্যাঙ্কে প্রবল চাপ তৈরি করে৷ এরপরই ট্যাঙ্ক থেকে গ্যাস বেরিয়ে আসতে থাকে৷ অকেজো প্ল্যান্টের অ্যালার্ম সিস্টেম সেদিন কাজই করেনি৷ মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যেই মারা যান বহু মানুষ৷ সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় ৩৭৮৭ জন মারা যান৷ যদিও বিভিন্ন সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা আট হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল৷ এ ছাড়া দুর্ঘটনার জেরে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন বহু মানুষ৷ ২০০৬ সালে হলফনামায় তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ সরকার জানায়, গ্যাস লিকের কারণে ৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ১২৫ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ যার মধ্যে ৩৯০০ জন আংশিক ও পুরোপুরিভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যান৷
গ্যাস লিকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহর যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়৷ হাসপাতালে রোগী ভর্তির হিড়িক৷ শ্বাসকষ্ট, চোখ ও ত্বকের সমস্যা, বুকে জ্বালায় ছটফট করছিল মানুষগুলো৷ ডাক্তাররাও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি এই অসুস্থতার আসল কারণ কী, তার চিকিৎসাই বা হবে কীভাবে! শহরের দুটি সরকারি হাসপাতালে প্রথম দু’দিনে ৫০ হাজার মানুষ ভর্তি হন৷ পরে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনায় মৃত ও আহতদের পরিবারকে মোট ৭১৫ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়৷
বেশ কিছু রিপোর্ট ইঙ্গিত করে, ওই সময় আমেরিকা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপর রীতিমতো চাপ এসেছিল অ্যান্ডারসনকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে৷ শাস্তি এড়িয়ে বিদেশে পালানোর বহু বছর পর, ২০১৪ সালে ফ্লোরিডায় ৯২ বছর বয়েসে অ্যান্ডারসনের মৃত্যু হয়৷ তবে আজও যেটা রহস্য রয়ে গিয়েছে, দিল্লি থেকে আসা একটা ফোন কলের ব্যাপারটি। শোনা যায়, ওই দুর্ঘটনার পর তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং-এর কাছে দিল্লি থেকে একটি ফোন কল এসেছিল, যাতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অ্যান্ডারসনকে যেন অবিলম্বে যেতে দেওয়া হয়৷ দিল্লি থেকে সেই রহস্যজনক ফোন কলটি যখন এসেছিল, তখন অ্যান্ডারসন ছিলেন সংস্থার গেস্ট হাউসে গৃহবন্দি৷ সেটি ঠিক কে করেছিলেন, যার জন্য গ্রেপ্তার হয়েও পালিয়ে যেতে পারেন বিদেশি শিল্পকর্তা!
এই ঘটনা সম্পর্কে যিনি সদুত্তর দিতে পারতেন, তিনি হলেন অর্জুন সিং৷ কিন্তু তিনিও ২০১১ সালে মারা যান৷ তা ছাড়া তিনি স্পষ্ট করে না বললেও যা জানিয়েছিলেন, তাতে যেন বিষয়টি আরও গুলিয়ে গিয়েছিল৷ তাঁর আত্মজীবনী ‘A Grain of Sand in the Hourglass of Time’ বইটিতে তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আর ডি প্রধানের নাম উল্লেখ করেছেন৷ অর্জুন দাবি করেন স্বরাষ্ট্রসচিব সেই ফোনটি করেছিলেন৷ অর্জুন সিংয়ের বক্তব্য, তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের নির্দেশে ওই ফোন কলটি এসেছিল৷ যদিও আর ডি প্রধান এমন অভিযোগ উড়িয়ে দেন। নিজের সপক্ষের যুক্তি হিসাবে তিনি দাবি করেন, সেই সময় তিনি আদৌ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন না, ওই সময় তিনি ছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যসচিব৷ তিনি ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন৷
১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর সিবিআই এই কেসটি নেওয়ার পরে অ্যান্ডারসনকে গ্রেপ্তার করেছিল৷ ওই বিপর্যয়ের চারদিনের মাথায় ৭ ডিসেম্বর, অ্যান্ডারসন ভোপালে এলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে মধ্যপ্রদেশের পুলিশ৷ তবে তারপরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউনিয়ন কার্বাইডের গেস্ট হাউসে, সেখানেই তিনি গৃহবন্দি ছিলেন৷ প্রশ্ন ওঠে- এমন ঘটনার অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর কেন থানায় না নিয়ে গিয়ে তাঁকে রেখে দেওয়া হয়েছিল তাঁরই সংস্থার গেস্ট হাউসে? ইউনিয়ন কার্বাইডের সেই গেস্ট হাউসে থাকাকালীন অ্যান্ডারসন ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি কোম্পানির আইনি পরামর্শদাতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন৷ ওই সময় ৬৩ বছরের মার্কিন শিল্পকর্তা নাকি কারখানায়ও যেতে চেয়েছিলেন। তবে স্থানীয় প্রশাসন তখন তাঁকে সে অনুমতি দিতে রাজি হয়নি৷
সেই সময় লোকসভা ভোট আসন্ন। অর্জুন সিং যখন প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই নাকি ওই বিশেষ ফোন কলটি পেয়েছিলেন৷ তারপরেই তিনি তাঁর আধিকারিকদের মার্কিন শিল্পপতিকে অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অ্যান্ডারসন মুক্তি পেয়ে যান৷ অভিযোগ, তারপরেই একেবারে সেখানকার এসপি এবং ডিএম তাঁকে এসকর্ট করে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন৷ শুধু তাই নয়, একেবারে রাজ্য সরকারের নির্দেশমতো প্লেনে করে তাঁকে দিল্লি পাঠানো হয়৷ অ্যান্ডারসনকে ২৫ হাজার টাকার বন্ডে ছাড়া হয়েছিল৷ ওই বন্ডে তিনি কথা দিয়েছিলেন, এই সংক্রান্ত মামলায় তাঁকে ডাকা হলে তিনি ভারতে ফিরে আসবেন৷ কিন্তু সে কথা রাখেননি ওই মার্কিনি সাহেবটি৷
এদিকে ভোপালের কালেক্টর মোতি সিং জানিয়েছিলেন, গৃহবন্দি থাকাকালীন ঘরে থাকা একটি ফোন থেকে আমেরিকায় কোনও লোকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন অ্যান্ডারসন, যাতে তাঁকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূতও ভারতীয় সরকারের উপর চাপ দিচ্ছিলেন তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য৷ তদন্ত কমিশনের সামনে ভোপালের তৎকালীন এসপি স্বরাজ পুরী জানিয়েছিলেন, অ্যান্ডারসনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল লিখিত নির্দেশে কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল মৌখিক নির্দেশে৷ একেবারে উপরমহল থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ এসেছিল৷ ৭ ডিসেম্বর যে উড়ানে চড়ে অ্যান্ডারসন ভোপাল থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন, সেই উড়ানের পাইলট সৈয়দ হাফিজ আলি জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে একজন কোনও ভিআইপিকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল৷ তিনিই যে অ্যান্ডারসন, দিল্লি আসার আগে সে কথা ওই পাইলট জানতেন না৷ তা ছাড়া দিল্লিতে নামার পর অ্যান্ডারসন কোনও কথা না বলেই একটি গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যান, ফলে তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপের আদৌ সুযোগ হয়নি৷ যদিও কার নির্দেশে কাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার প্রমাণস্বরূপ ওই উড়ানের লগবুকটি এখন আর এই দেশে নেই৷ ওই এয়ারক্রাফট হাতবদল হয়ে পরে বিদেশি সংস্থার হাতে চলে গিয়েছে৷
ওই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই হয়েছিল লোকসভা ভোট৷ সেই ভোটে অবশ্য রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জেতে৷ অদ্ভুতভাবে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুতে সহানুভূতির হাওয়া এতটাই জোরদার ছিল দেশে, যে, সেখানে ভোপালের গ্যাস বিপর্যয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কোনও দাগ কাটতে পারেনি৷ সেবার ভোট হয়েছিল ৫৩৩টি আসনে এবং তার মধ্যে ৪০৪টি আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস৷ এমনকি কংগ্রেস মধ্যপ্রদেশেও খুব ভালো ফল করে। ভোপাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন কংগ্রেসের এন কে প্রধান৷
২০১০ সালে ক্ষতিপূরণ বাড়াতে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিকারমূলক আবেদন দাখিল করার পর বলা হয়, বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৫২৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪৯৪৪ জন নানারকম অসুখে গুরুতর ভাবে অসুস্থ৷ তবে জীবিতদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের দাবি, মৃত্যু এবং গুরুতর অসুস্থের সংখ্যা আরও বেশি৷ এখনও অনেকেই ঠিক মতো পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে৷ অভিশপ্ত পরিত্যক্ত কারখানায় এখন বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ৷ তবে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পরে এখনও ওইসব অঞ্চলে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে, বিশেষজ্ঞরা অনেকেই এ কথা বলেন। কারখানা চত্বরে বেশ ঝাঁঝালো গন্ধ টের পাওয়া যায় বলেও শোনা গিয়েছে। এমনিতেও, ১৯৮৪-র গ্যাস লিকের দুর্ঘটনার আগে থেকেই কারখানা এলাকায় যে রাসায়নিক বর্জ্য জমত, তার প্রভাবে বহু বছর ধরেই এখানকার মাটির তলার জল বিষাক্ত।
বিষ কেবল একদিন ছড়ায়নি। বিষাক্ত পরিবেশ আর বিষাক্ত স্মৃতি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে ভোপালের বাতাসে। তবে সে বাতাস বিষ-ঢেলে-দেওয়া কারখানা মালিক কিংবা রাজনীতির কারবারি, কাউকেই ছুঁতে পারেনি কোনও দিন।