তিথিভিত্তিক পুজোর দিনে বাজারকেন্দ্রিক প্রেমের দিন এসে মিশে গেলে, পুজো আর প্রেমের যুগলবন্দি নিয়ে নতুন করে কথা হয়। তবে, যে জাতির একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন, সে আগাগোড়াই জানে, পর্যায়ে পুজো আর প্রেম পাশাপাশিই থাকে। যেন কবির অভিপ্রায়কে অগ্রাহ্য করেই মাঝেমধ্যে মিশেও যায়, আলাদা করতে পারা যায় না কিছুতেই। বাঙালি প্রেমের চলন-বলন নিয়ে দু-চার কথা, যা না বললেই নয়, সরস্বতী পুজো আর ভ্যালেন্টাইন্স ডে মিলে যাওয়া বসন্তদিনে সে কথাই শোনালেন সরোজ দরবার।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
যে জন প্রেমের ভাব জানে না, সে যে আদৌ সোনাদানা চেনে না, এ-কথা আর কেউ না জানলেও বাঙালি দিব্য জানে। অবশ্য এ-কথা দুনিয়া জানে যে, খাঁটি আর নকল সোনা এক নয়। তা চেনা আর এমন কী কষ্টের কাজ! স্যাকরার ঠুকঠুক একটু-আধটু জানলেই কেল্লা ফতে। আজকাল তো আবার হলমার্কের যুগ। অতএব আসল-নকলের ভ্রান্তিবিলাস এত সহজে হওয়ার নয়। তবে কিনা দুনিয়া যা জানে আর বোঝে বলে বিশ্বাস করে, বাঙালি যদি সেটুকুতেই ভুলে থাকত, তাহলে আর সে বাঙালি কেন! ক্ষেত্রবিশেষে নকলই যে আসল, এই ব্যুৎপত্তি বাঙালির ব্যক্তিগত। বিশেষত প্রেমের এই সত্যি সে মর্মে মর্মেই টের পেয়েছে।
‘আসি’ বলে যে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায়, বাংলা ভাষারই আছে এই আশ্চর্য ঐশ্বর্য। আর সে কথা ধরিয়ে দেবেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যিনি আবার বাঙালিকে উপহার দিয়ে যাবেন অকালবসন্ত এবং অপারবসন্ত– কেননা তাঁর কাছে বাঙালি শিখে নেবে অপূর্ব মন্ত্রগুপ্তি- ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। যে-ভাষার অন্দরমহলে অভিব্যক্তির এমন দ্বৈত আলোছায়া অবিরাম খেলা করতে থাকে, সে-ভাষায় প্রেমের প্রকাশও যে অন্যরকম, তাতে আশ্চর্য হওয়ার বোধহয় কিছু নেই। সুতরাং, বাঙালি শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা হিসাবে অনায়াসে বেছে নিতে পারে অদ্বিতীয় সুকুমারীয়-কৌতুক-
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি,
খাসা তোর চ্যাঁচানি!
…
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে-
চাঁদ মুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু’নয়ান।
সত্যি বলতে, প্রেমের এমন সরল এবং সর্বজনীন প্রকাশ আর দ্বিতীয় দেখা যায় না। অথচ এই পঙক্তির ভিতর না আছে বসন্ত, না আছে চাঁদের আলো, না আছে জোয়ার, না আছে গোলাপ। তবে, সত্যিই কি নেই! ওই ‘সব ভুলে গেছি রে’-র সামনে এসে পড়লেই তো বোঝা যায়, ফুল ফুটুক বা না-ই ফুটুক আজ বসন্ত কতখানি সত্যি। বাঙালি যাকে ছেলেভুলানো ছড়া বলে ভুল করে, বাঙালির নাগরিক কবিয়াল কবীর সুমন যে সেটিকেই দুরন্ত প্রেমের কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করেন, তা সঙ্গত কারণেই। ভাষার ভিতর যে আশ্চর্য সরস্বতী-স্রোত বইয়ে দিতে পারেন সুকুমার, তার জোরেই আমাদের অনুভব পেয়ে যায় অনন্যতা। ‘যা বলা হয়’, আর ‘যা বলতে চাওয়া হয়’ তার মধ্যবর্তী মহাকাশটিকে সঙ্গী করেই এগিয়ে যায় ভাষা। বাঙালির প্রেমের ভাষাও তাই কিঞ্চিৎ অন্যরকম। সুমন স্বয়ং প্রেমের অপূর্ব পঙক্তি আমাদের উপহার দিয়েছেন। বাঙালি জানল, ‘না-পাওয়ার রং’ দিয়েও নামিয়ে আনা যায় অলীক বসন্ত। বাঙালির কাঁচা, ভীরু প্রেম ‘আমার পরান যাহা চায়’ ঘোষণা করেও শেষমেশ বলে উঠতে পেরেছিল, ‘তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো’।
তবে মুশকিল হল অন্য জায়গায়। পলাতকা ছায়া ফেলে যে এসেছিল, তবু আসে নাই জানিয়ে গেল, তার প্রেমকে ছোঁয়া তো সহজ ব্যাপার নয়। এই আসার ভিতর না-আসার মধ্যেই প্রেম অপার্থিব। সুতরাং ‘তোমার সে উদাসীনতা’ সত্য কি না জানা যায় না। যে বেদনা ঘাসে ঘাসে মেলা থাকে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। উত্তরকাল তাই কাতর মিনতিতে বড়জোর বলে উঠতে পারে, ‘উদাসীন থেকো না, সাড়া দাও’। বাঙালির প্রেম এ-ও জানে, ভুলে যাওয়া যে-পথ ধরে এতদূর আসা, সে-পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে; আর সন্ধ্যাতারাটির খোঁজ তো সেই মেয়েটির কাছেই। এ সবই মন জানে, তবু যেন জানে না, ‘কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে’। জানা আর না-জানার এই চোরাটানেই বাঙালির প্রেম তরতরে।
সুতরাং এই যে প্রেমের ভাব, যা কিনা বাঙালির নিজস্ব, তার আসল-নকলের ভেদ বোঝা সত্যিই শক্ত। ভাষা অতিক্রম করে ভাষার অতিরিক্ত সেই আকাশ স্পর্শ করা সহজ নয়। বাঙালির গীতিকা-কাব্যের মহুয়া তাই যখন নদ্যার ঠাকুরকে বলে, ‘লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর’, আমরা বুঝি আসলে সে কী বলছে! এই কৃত্রিম ভর্ৎসনাই তো প্রেমে স্বীকৃতি। বিবাহপ্রস্তাবের এমন অপূর্ব জবাব প্রায় অকল্পনীয়। আর এই উলটো জবাবের ভিতরকার কথাটুকু জানে বলেই পুরুষটি উত্তরে যা বলে, তা হয়ে উঠতে পারে অন্যতম প্রেমের কবিতা-
কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি।
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি।।
প্রেমে এই ডুবে মরাই যে আশ্চর্য বেঁচে ওঠা তা আর কে না জানে! দীনেশচন্দ্র যে মহুয়া-মলুয়ার মতো নারীচরিত্রে প্রেমের দুর্জয় শক্তি দেখেছিলেন, তা একেবারেই খাঁটি। বলেছিলেন, ‘নারীপ্রকৃতি মন্ত্র মুখস্থ করিয়া বড় হয় নাই- চিরকাল প্রেমে বড় হইয়াছে’। এই প্রেম বিচিত্র বলেই মনোহর। তার কাছে তাই সম্ভবত কেউ কথামৃত প্রত্যাশাও করে না; বরং বংশীহতা আগাগোড়াই জানে, মুরলী বাজানো হয় ‘বিষামৃতে মিশাল করিঞা’। অস্ত্র নয়, তবু সে মনে ফুটে ‘কাটারিতে যেন কাটে/ ছেদন না করে হিয়া মোর’। কেটে ফেললে তো ল্যাটা চুকেই গেল, কিন্তু এই কোপ আর ছেদন না-হওয়ার ভিতর যে যুগল-সম্ভাবনারই তীব্র আকুলতা লুকিয়ে, বাঙালির প্রেমের পদাবলির সকল মাধুর্য সেইখানেই নিহিত। অতএব তার প্রেম চিরকাল বাঁকা পথেই চলে। ভাবুন তো, সেই যে হুট বলতে বলা-নেই কওয়া-নেই মেস থেকে বাড়ি ফিরে গেলেন তুলসী চক্রবর্তী। আর ছেলেমেয়েদের সামনে স্বামীটির অতিরিক্ত ‘ছোঁকছোঁক’ দেখে মলিনা দেবীর সেই তীব্র ভর্ৎসনা, তা কি আদতে প্রেম নয়।
কোথায় গেল সেই গন্ধমাখা চিঠি, আবার দিব্যি দেওয়া সাড়ে চুয়াত্তর, সেই প্রাণনাথ বলে সম্বোধন! আক্ষেপ করে পুরুষটি। আর নারীটি যেন ছোবলাতে থাকে বিষবাক্যে। কিন্তু কে না জানে, এই সবটাই ছলনা মাত্র। ব্যজস্তুতিকে যে ভালোবাসার অলংকার করে তোলা যায় অনায়াসেই, সে কি আর মঙ্গলকাব্যের বাঙালির জানতে বাকি আছে! অতএব রাগ দেখিয়ে তুলসী যখন চলে যাচ্ছেন, আর মলিনা দেবী সেই অবিস্মরণীয় কান্না-চাপা অভিমানী ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠছেন, ‘চলে গেল!’- তখনই বোধহয় লেখা হয়ে যায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। এরকম উলটো পথেই বাঙালির প্রেম তাঁর চিরন্তন সত্তাকে খুঁজে পেয়েছে। দর্পিণী সুচিত্রা সেন যখন উত্তমকে ভুল বোঝা আর ভুল ভাঙার শেষে কাছে টেনে নেন, আর যেতে না দেওয়া জোর কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে, ঈষৎ কাঁপা অধরে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ জোর’, তা তো আসলে হয়ে ওঠে সমর্পণেরই সমূহ স্বীকারোক্তি। বাঙালি এই প্রেমকেই পূজনীয় করেছে। কখনও সখনও তিথিভিত্তিক পুজোর দিনে বাজারকেন্দ্রিক প্রেমের দিন এসে মিশে গেলে, পুজো আর প্রেমের যুগলবন্দি নিয়ে নতুন করে কথা হয়। তবে, যে জাতির একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন, সে তো আগাগোড়াই জানে, পর্যায়ে পুজো আর প্রেম পাশাপাশিই থাকে। যেন কবির অভিপ্রায়কে অগ্রাহ্য করেই মাঝেমধ্যে মিশেও যায়, আলাদা করতে পারা যায় না কিছুতেই।
বাঙালির প্রেম আর পুজোর এমনই সেতু। এমনই যোগাযোগ তার ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’-এ। বৈপরীত্যের এমনই গরিমা তার ভাষায়, প্রেমের প্রকাশভঙ্গিমায়। বাঙালির ‘সত্য’ তাই কাঁচা বয়সে ভুল করে ভেবে ফেলে যে, ‘বুঁচকি’ বড় গোলমেলে জবাবই দিয়েছে। ভাগ্যিস চিরকাল একজন ‘নিবারণ’ থাকে, যে ভুল ভাঙিয়ে চিরকাল বুঝিয়ে দেয়– ‘দূর গাধা, যাঃ মানেই হ্যাঁঃ’।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী