সামাজিক স্বীকৃতি তো দূরের, নিজের পরিবারের থেকেও মিলেছিল শুধু তাচ্ছিল্য আর অবহেলা। তবে সেই আশা পূরণ হল শেষমেশ অন্য কোথাও এসে। নতুন পরিবার খুঁজে পেলেন চন্ডীগড়ের এক রূপান্তরকামী দম্পতি। খুঁজে পেলেন নতুন বাবা-মা। চন্ডীগড়েরই এক নবতিপর দম্পতি দত্তক নিলেন তাঁদের। রক্তের সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে তৈরি হল মানবিক সম্পর্কের অনোন্য নজির। শুনে নিন, তাঁদের কথাই।
পরিবার মানে তো আসলে বেঁধে বেঁধে থাকা। আর তা রক্তের সম্পর্কেরও উর্ধ্বে। আর সেই কথাই বোধহয় ফের একবার প্রমাণ হয়ে গিয়েছে চন্ডীগড়ের এই দম্পতির ক্ষেত্রে। তাঁরা আর পাঁচটি দম্পতির থেকে আলাদা। কিন্তু আলাদা মানেই যে ভুল, তা তো নয়। আর সেই ধারণাটা পাল্টে ফেলতেই সেই কবে থেকে লড়াই করে চলেছেন ধনঞ্জয় ও রুদ্র। আর সেই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছেন নবতিপর এক দম্পতিকে। পেয়েছেন নতুন পরিবার।
গোটা ঘটনাটা তবে খুলেই বলা যাক। ধনঞ্জয় আদতে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। রূপান্তরকামী আন্দোলেনর একজন সক্রিয় কর্মীও বটে। চন্ডিগড় ইউনিভার্সিটির প্রথম রূপান্তরকামী পড়ুয়া ধনঞ্জয়। নিজের জীবনেও তাঁর যুদ্ধের শেষ নেই। সমাজের কম কটাক্ষের শিকার হতে হয়নি ধনঞ্জয়কে। তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা, কার্যত ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল তাঁর নিজের পরিবারই।
আইনত তাঁরা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে মর্যাদা পেলেও সমাজের আজও তাঁদের পরিচয় কেবল ‘কিন্নর’ বলেই। তবে সেই পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে নতুন পরিচয় বানাতে চান ধনঞ্জয়। সেই জন্যই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। খুঁজে পেয়েছেন জীবনসঙ্গী রুদ্রকেও। তবু এত সব কিছুর মধ্যেও পরিবারের অভাব সবসময়ই কষ্ট দিত তাঁদের। অবশেষে সেই আশা পূরণ হয়েছে। ধনঞ্জয় ও রুদ্রকে সন্তান হিসেবে দত্তক নিয়েছেন চন্ডীগড়ের এক নবতিপর দম্পতি।
আরও শুনুন: ডাউন’স সিন্ড্রোমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাবার সঙ্গে এভারেস্ট চড়ল সাত বছরের খুদে
৯৩ বছরের শামসের ও তাঁর স্বামী ৯৫ বছরের দরবারা সিং চহ্বাল। দরবারা সিং ছিলেন পেশায় উকিল। আপাতত সেই চহ্বাল পরিবারেরই নতুন সদস্য ধনঞ্জয় ও রুদ্র। ধনঞ্জয়কে তাঁদের তৃতীয় মেয়ে হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন চহ্বাল দম্পতি। তাঁদের নিজস্ব দুই সন্তানও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী। অন্যজন আমেরিকায় নামী স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ। চহ্বাল দম্পতির এই সিদ্ধান্তে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তাঁরাই।
নতুন বাবা-মা, পরিবার পেয়ে আপ্লুত ধনঞ্জয় ও রুদ্র। তাঁদের কথায়, চহ্বাল দম্পতির সঙ্গে তাঁদের যে টান, তা রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি। একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে অপেক্ষা, উদ্বেগ- এই সবটাই পেয়েছেন নতুন পরিবারে এসে। চহ্বাল দম্পতির দুই মেয়ের সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্কটা অত্যন্ত মধুর। তাঁদের ছেলেমেয়েরা ধনঞ্জয়কে মাসি বলেই ডাকে। সব মিলিয়ে নতুন পরিবার অনেক কিছু দিয়েছে তাঁদের।
আরও শুনুন: কর্মীরাই সম্পদ… মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল কর্মীদের ৭৪ হাজার টাকা বোনাস, নজির মালিকের
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন রূপান্তরকামীরা। এমনকি ভারতে দাঁড়িয়ে নিজের লিঙ্গ বেছে নেওয়ার অধিকারও তাঁদের দিয়েছে সংবিধান। তবে খাতায়কলমে নিয়ম বদলালেও সমাজ কি আদৌ বদলেছে? ধনঞ্জয়ের কথায়, সমস্তটা বদলাতে হয়তো আরও একশো বছর সময় লেগে যাবে। এখনও বাড়ি ভাড়া পেতে বা ঘর খুঁজতে গেলে নানাবিধ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয় রূপান্তরকামীদের। এখনও সমাজের চোখে তাঁরা ‘ভিখিরি’ ছাড়া কিছুই নন। সত্যি কথা বলতে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে আজও তেমন করে মাথা ঘামায় না সরকার। নেই তাঁদের উন্নয়নের জন্য কোনও প্রকল্প বা ভাবনাও। ফলে সাম্য আসাটা সহজ কথা নয় বলেই মনে করেন ধনঞ্জয়রা।
তবে আশার কথা একটাই, চহ্বাল দম্পতির মতো মানুষদের হাত ধরেই ক্রমে আলোর দিকে এগোচ্ছে সমাজ।