এশিয়ার নানা দেশে রাম তথা রামায়ণ ছড়িয়ে রয়েছে, রাম মন্দিরের ভূমিপূজায় গিয়ে এ কথা বলেছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক কালে রামকে যে একমাত্রিকতায় প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তার পালটা এক বহুত্ববাদকেও চিনে নেওয়া যায় রামকে কেন্দ্র করেই। দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন রামায়ণ কি সে কথাই মনে করিয়ে দেয়? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রামের হারানো আংটি খুঁজতে পাতালে গিয়েছেন হনুমান। সেখানে রাজার সামনে সাজানো হাজার হাজার আংটি। রাজা জানালেন, প্রতিটি আংটি আসলে রামের একেকটি জীবন। মর্তে রামের জীবন ফুরোলেই তাঁর আংটি পাতালে এসে পড়ে, আর এমন করেই এতগুলি আংটি জমে উঠেছে। আসলে এই লৌকিক গল্প এমন ইঙ্গিতই দিয়েছিল যে, যেমন হাজার হাজার আংটি হাজার হাজার রামের, তেমনই হাজার হাজার রাম নিয়ে থাকবে হাজার হাজার রামায়ণও। কোনও একটিমাত্র রামায়ণ নয়, ভারতে এবং বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে একাধিক রামকথাই। আর সেইসব রামায়ণে বহু রূপে, বহু স্বরূপে ধরা দিয়েছেন রাম।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
যেমন ধরা যাক, বিমলসুরির জৈন রামায়ণ ‘পৌমাচারিয়া’, সংস্কৃতে যা ‘পদ্মচরিত’। তা বাল্মীকি রামায়ণের মতো রাবণকে একেবারে খলনায়ক বলে মনে করে না। বরং রাবণকে একজন সদাচারী জৈন সাধক বলে মনে করা হয়েছে এখানে। দক্ষিণ ভারতের কন্নড় রামকথায় আবার সন্তানলাভের জন্য শিবের হাত থেকে একটি আম মিলেছিল রাবণের। আর তাঁর হাঁচির মধ্যে দিয়ে জন্ম হয় সীতার। কোথাও আবার সন্তান কামনায় যজ্ঞে আহুতি দিলে রাজা দশরথ একমুঠো ভাত পান। একটি কাক সেই ভাতের কিছুটা চুরি করে রাবণের স্ত্রীকে দেয়, আর তা থেকেই সীতার জন্ম। বাংলায় চন্দ্রাবতী বা তেলুগু ভাষায় মহিলা কবি মোল্ল যে রামায়ণ লেখেন, তাতে আবার উঠে আসে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে অনেকখানি গুরুত্ব পেয়ে যান সীতা।
‘থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণাস’ অর্থাৎ তিনশো রামায়ণ প্রবন্ধে রামায়ণের এই বিপুল বিস্তারটিকেই ধরতে চেয়েছিলেন ভাষাতাত্ত্বিক গবেষক এ কে রামানুজন। বিশ্বজুড়ে কোন কোন ভাষায় রামায়ণ লেখা হয়েছে, এই প্রবন্ধে তার একটি তালিকা দিয়েছিলেন তিনি। তাতে দেখা গিয়েছিল, দেশীয় ভাষার মধ্যে সংস্কৃত, বাংলা, মারাঠি, ওড়িয়া, কন্নড়, গুজরাটি, সাঁওতালি, কাশ্মীরি এমন একাধিক ভাষায় তো রামায়ণ রয়েছেই। দেশের বাইরেও চিন, জাভা, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, বালি, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো নানা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে সেখানকার ভাষায় লেখা রামায়ণ। বহির্বিশ্বে ‘রামায়ণ’-এর সম্ভবত প্রাচীনতম লিখিত উল্লেখটি রয়েছে চিনে প্রচলিত অনূদিত ‘মহাবিভাষা’য়। কেবলমাত্র সংস্কৃত ভাষায় লেখা রামায়ণের মধ্যেই অন্তত ২৫ রকম রূপভেদের খোঁজ মেলে। ইন্দোনেশিয়ায় রামকথার অন্তত ছটি লিখিত নিদর্শন প্রচলিত, এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যোগীশ্বর রচিত ‘কাকাবিন রামায়ণ’। আবার ইয়েমেনে প্রচলিত রামায়ণ কাহিনিতে পাওয়া যাবে ইসলামি যোগও।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
ভারতে থেকে, রামায়ণের এই বৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করেছিলেন বেলজিয়ান মিশনারি ক্যামিল বুল্ক। তিনিই প্রথম বলেছিলেন যে রামায়ণের অন্তত তিনশোটি কথন রয়েছে। রামানুজনের চর্চায় সেই কাজই আরও গতি পেয়েছে পরে। আসলে মহাকাব্যের বীজটি ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়লেও এক এক দেশের জলহাওয়া তাকে এক এক ভাবে গড়েছে। তাই রামায়ণের এই বৈচিত্র্যকে তলিয়ে দেখলে জারি থাকতে পারে ভিন্নমতকে মর্যাদা দেওয়ার অভ্যাসও।